English | বাংলা
Logo
 

 

স্বৈরতান্ত্রিক শুভবোধ ও চিন্তাদাসত্বের রাষ্ট্রপ্রণালী

সরন-প্রতিসরণ, ০৮-০১-২০১৪

 


Artwork: Michael Hutter. 2011


অচেনা দাগ
পঁচিশতম অধ্যায়


 

২৫.১ সর্বদলীয় রাজতান্ত্রিক ইশতেহার


চিন্তাদাসত্বের গোলকধাঁধায় পড়েছে বাংলাদেশ। গোলকধাঁধাটা এত আন্তরিক কায়দায় বানানো হয়েছে যে গোলকত্বও বোঝা যায় না, ধাঁধাময়তাও বোঝা যায় না দাসত্ব তো দেখাই যায় না। আন্তরিকতাই এখানে মুখ্য। মালিক আন্তরিক তো বটেই, দাসও আন্তরিক। আন্তরিক দাসপ্রথা। এ প্রথা অন্তরের। মগজের। চিন্তার। চিন্তাদাসত্বের নতুনতর রাষ্ট্রপ্রণালী বিকশিত হতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। সংবিধানে আছে, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। কথাটা কথার কথা হিসেবেই আছে বটে সংবিধানে। কিন্তু খালি খালি এরকম একটা বিপজ্জনক কথা সংবিধানে যোগ করার দায় পড়েছিল কেন সংবিধান-প্রণেতাদের? দায় ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের। একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা ছিল রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা। এখন সেই একাত্তরের নাম ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে বানানো হচ্ছে জনগণের মালিক। রাষ্ট্র এখন মালিক। জনগণ তার দাসত্ব করবে। যিনিই এই দাসত্বকে প্রশ্ন করবেন, তিনিই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান না বলে ধরে নেবেন রাষ্ট্র-ম্যানেজারবৃন্দ। তাঁর কপালে দুঃখ আছে। গভীর দুঃখ।


যেহেতু দেশে যুদ্ধাপরাধের বহুপ্রতিক্ষিত বিচার চলছে, এবং যেহেতু সেই বিচারের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তৎপরতা চলছে প্রকাশ্যে, এবং যেহেতু পাকিস্তানী পার্লামেন্ট আইনত বলছে রাজাকার কাদের মোল্লা তাঁদের লোক, এবং যেহেতু বিএনপি-নেত্রী খালেদা জিয়া পাকিস্তান-পার্লামেন্টের এই প্রকাশ্য বাংলাদেশ-বিরোধিতার মুখেও সপ্তাখানেক থ মেরে বসে থেকে পরে বলছেন তিনি মর্মাহত, এবং যেহেতু এটা এখন চরম সুস্পষ্ট যে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী আসলে পাকিস্তানভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের বাংলাদেশ শাখা মাত্র, এবং যেহেতু তা হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি জামায়াতের কোল থেকে নামতে রাজি না, সেইহেতু আওয়ামী-বাম মহাজোট রাষ্ট্রের তরফে আপাতত সবকিছুই জায়েজ।


সেই হেতু বিনাভোটারের, বিনাপ্রতিদ্বন্দিতার, আগুনের, লাশের, বন্দুকতন্ত্রের নির্বাচনী তামাশাই এখনকার বৈধ রাষ্ট্রপ্রণালী। নির্বাহী বিভাগের তার-ছেঁড়া বীণা বাজিয়ে চলেছেন নির্লজ্জ নির্বাচন কমিশন। দাসত্বের পরাকাষ্ঠা ফুটে উঠছে কমিশনারদের চেহারায়। মাঝখান থেকে এই গরিব দেশের মানুষজনের ট্যাক্সের কয়েক শ কোটি টাকার শ্রাদ্ধ। ‘সংসদ’, ‘সংবিধান’, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’ ইত্যাদি যে সর্বাত্মক ক্ষমতাধরদের পায়ের ফুটবল মাত্র সে কথা এখনও যাঁরা আত্মস্থ করেন নি তাঁদের জন্য আছে চলমান রাষ্ট্রীয় টিউটোরিয়াল। ফটকা পুঁজির নিওলিবারাল যুগের প্রশ্নাতীত প্রবর্তন ঘটাতে হাতে বন্দুক পায়ে বন্দুক নিয়ে এই টিউটোরিয়াল ক্লাসের সূচনা ঘটিয়েছিলেন এক-এগারোর কুশীলবগণ। তাঁদের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন আওয়ামী-বাম মহাজোটের সরকার।

নিওলিবারাল ক্যাপিটালিজম ওরফে কাছাখোলা-পুঁজিবাদ কী বস্তু? এ হলো পুঁজিবাদের নয়া উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মূল কথা হলো ঋণপ্রথা, আর সুদপ্রথা। রাষ্ট্রের উদারতা থাকবে শত কোটি টাকা ঋণগ্রহিতা বড়লোকের প্রতি। গরিবের গলায় থাকবে গামছা। কারখানা-উৎপাদন এই পুঁজিবাদের মূল কারবার নয়। শুধু উৎপাদনে মুনাফা অনন্ত হয় না। অনন্ত মুনাফার জন্য লাগে ‘অনন্ত জলিল’ । তাই এই পুঁজিবাদের আসল ঘটনা হলো নিরাকার হিসাবনিকাশ। শুধু মাত্র হিসাবনিকাশের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে টাকা যাবে রাক্ষস-বড়লোকের পেটে। সেই পেট পাহারা দেবে রাষ্ট্র-রাক্ষস। পাহারার উসিলা হিসেবে লাগবে শুধু শত্রু। রাষ্ট্রের শত্রু। জনগণের শত্রু। স্বাধীনতার শত্রু। শত্রু বানাতে লাগে প্রচারযন্ত্র। কেননা কুত্তাটাকে মেরে ফেলার আগে সবাইকে জানিয়ে রাখতে হয় যে কুত্তাটা আসলে পাগলা কুত্তা। নিওলিবারাল পৃথিবীতে সব টিভিই বিটিভি। সুতরাং শত্রুর কোনো অভাব নাই। যুক্তরাষ্ট্রে আছে আল কায়দা, ভারতে মাওবাদ, বাংলাদেশে রাজাকার। শত্রু সুস্পষ্ট। শত্রু খতরনাক। সুতরাং গুলি চালাবে রাষ্ট্র। যার গায়ে লাগে লাগুক। সুতরাং বন্দি করবে রাষ্ট্র। জেলখানার পেট ভরলেই হলো। নিওলিবারাল পুঁজিবাদ মানেই তাই সদাচলমান ‘জরুরি জমানা’। সর্বত্র সর্বোচ্চ সতর্কতা। নিওলিবারাল পুঁজিবাদ মানে তাই সুশীলতা এবং সামরিকতা। ‘সুশীল-সামরিক জরুরি জমানা’রই আরেকটা নাম তাই ‘সুশীল-সামরিক জেল জমানা’।

আদতে বাংলাদেশের সমাজ এখনও সামন্ত-সমাজ। জমিদারি সমাজ। জমিদার-তহশিলদার-নায়েব-গোমস্তা-উকিল-মোক্তার-পণ্ডিতে ভরপুর এই সমাজ। এ সমাজ এখনও মনে করে সব মানুষ সমান না। এখানে ট্রেনের টিকেট কাটার লাইনে পর্যন্ত কর্নেল আর কনডাকটর সমমর্যাদার অধিকারী নন। এ সমাজ মনে করে সব মানুষই প্রকৃতপক্ষে সম্মানের অধিকারী নয়। আলাদা লোক আছেন। মানী লোক। ‘মানী লোকের মান রক্ষার দায়িত্ব’ এখানে মানসম্মানহীন নালায়েক-নাবালক আমজনতার। নিজের মর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে নায়েব-নবাবদের পায়ে লুটিয়ে পড়ার জন্য এখানে মুখিয়ে থাকে মানুষ। জমিদার যেমন তাঁর জমিদারির সমস্ত পোকা-মাকড়ের (পড়ুন মনুষ্যসন্তানের) জীবনের মালিক, তেমনই এ রাষ্ট্রের অফিসার-প্রফেসর-জেনারেল-বিচারকরা সকলেই একেক জন জমিদার। জমিদারি প্রথা এ রাষ্ট্রের ছত্রে ছত্রে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এমন এক সমাজ এই সামন্ত-সমাজ নামের বস্তুটা যেখানে এখনও মা-বাবারা সন্তানের নাম রাখেন ‘রাজা’ ‘বাদশাহ’ ‘নবাব’ ‘সম্রাট’। গাছতলার আমজনতার সুফিসাধকও মৃত্যুর পরে এদেশে ‘সুফিসম্রাট’ উপাধি পান। [চালচুলাহীন] শাহ আব্দুল করিম পান ‘বাউলসম্রাট’ উপাধি। রাজা-বাদশাহ-নবাব-সম্রাট-জমিদারদের সামন্ত খোঁয়ারি আমাদের দেশ থেকে যায় নি এক ফোঁটাও। হাসিনা-খালেদা-এরশাদেরা এদেশে একেক জন জমিদার-বাদশাহ হবেন তাতে আশ্চর্য কী! [তাতে তাঁদের দোষই বা কী। প্রজারা যেমন, তেমন রাজাই তাঁরা পাওয়ার যোগ্য। রাজাতন্ত্র-প্রজাতন্ত্রই তো চলছে এখনও, তাই না?]

আজকের নিওলিবারাল অর্থনীতি এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজনীতির বিষাক্ত যোগসূত্র [তথা ‘ক্ল্যান ক্যাপিটালিজম’ ওরফে ‘গোত্র-পুঁজিবাদ’] আমাদের রাষ্ট্রকে করে তুলেছে আরো ভয়ঙ্কর। এমন একটা সামন্ত-বাংলাদেশে নিওলিবারালিজম এসে ঢুকছে যেখানে কারখানা-পুঁজিবাদই গড়ে ওঠে নি কখনোই। এখানে পুঁজি মাত্রই ফটকা পুঁজি। একমাত্র সহায় রাষ্ট্র। গ্রামের ফকিন্নিও এখানে জানেন, এ দেশের সকল ধনসম্পত্তি-দুগ্ধদ্রব্য শুষে এনে জমা করা থাকে রাষ্ট্রের ভাণ্ডারে। একবার কোনো রকমে রাষ্ট্রের কোনো একটা পাইপলাইনের সাথে কানেক্টেড হয়ে যেতে পারলেই হলো, দুগ্ধজাত চিক্কন দ্রব্যসকল আপনাতেই চুঁইয়ে পড়তে থাকবে আপনার পেয়ালায়। অবিরাম। আপনাকে শুধু তৈল সহযোগে রক্ষা করতে হবে রাষ্ট্রীয় সংযোগটুকু। অবিরাম তৈল সহযোগে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দুধ দোয়ানোর জন্য এখানে চাই তদ্বিরের গোয়ালা। সুতরাং তৈলতদ্বিরতন্ত্র এখানে একচ্ছত্র। বৃটিশ আমল থেকে। এমনকি সেন-বর্মণ-মুঘল আমল থেকে। এই তৈল-তদ্বিরের পদ্ধতি-প্রণালী এখানে রাজনীতি নামে বিখ্যাত। এ রাষ্ট্রের রাজনীতি আদতে তাই একদিকে জমিদারি-নীতি, অন্যদিকে চামচা-নীতি। এখানে রাজনীতি মানে স্রেফ রাজতন্ত্র। এখানে রাজনৈতিক দল মানে তাই জমিদারের লাঠিয়াল-বাহিনী। এখানে রাজনৈতিক দল মানে জ্ঞাতি-সম্পর্ক, বংশ-পরম্পরা। সর্বোপরি, এখানে রাষ্ট্র মানে প্রধানমন্ত্রীর জমিদারি, কিংবা রাষ্ট্রপতির বাদশাহী।

জমিদারি-বাদশাহী মানেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। আজকে আমি বাদশাহ-জমিদার, কালকে আমি পথের মানুষের মতো চলাফেরা করব এ হতেই পারে না। সুতরাং বাদশাহ মানে চিরকালের বাদশাহ। জমিদার মানে চিরকালের জমিদার। রাজার ছেলে রাজা। ছেলে না থাকলে রাজার মেয়ে রাজা। মেয়ে না থাকলে রাজার বউ রাজা। বউও না থাকলে রাজার ভাই রাজা। সুতরাং যেকোনো উসিলাতেই হোক, জমিদারি চিরকাল থাকতে হবে আমার বংশের হাতে। যেকোনো উসিলাতেই হোক, আমার রাজত্বের শত্রুদের আমূল বিনাশ সাধন করাটা আমার ‘রাজনৈতিক কর্তব্য’, ‘রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি’, ‘ইতিহাসের দায়’ হয়ে উঠতে বাধ্য। এই কর্তব্য-কর্মসূচী-দায় জেএমবি থেকে জনযুদ্ধ পর্যন্ত্র আমাদের যাবতীয় ডান-বাম রাজনৈতিক দলের একমাত্র রাজনৈতিক ইশতেহার। এই ইশতেহারের বাস্তবায়ন আমরা ঘটতে দেখছি গত ৪০ বছর ধরে।


২৫.২ রাজনীতির রাক্ষসতন্ত্র


এ উসিলায় সে উসিলায় রাষ্ট্র জিনিসটাকে রাক্ষস বানিয়ে তোলা কঠিন কাজ নয়। কঠিন হলো রাক্ষসটাকে পরে সামলানো। এ রাক্ষস শুধু খায় যে! তাজা মানুষের রক্ত খায়, মাংশ খায়। নইলে তার নেশা হয় না। মন ভালো লাগে না। বিষণ্ণ লাগে। পরে যখন এই রাক্ষস-স্রষ্টা ফ্রাংকেনস্টাইন মহোদয় বলবেন, ‘ঠিক আছে ভাই রাক্ষস, এবার থামো’, রাষ্ট্র-রাক্ষস তখন বলবেন, ‘ঠিক আছে ভাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, আসুন এবার আপনাকে খাই। আপনি আমার খাওয়ার পথের বাধা হয়ে উঠেছেন।’

আমাদের রূপকথায় ‘রাক্ষস’-এর পরিচয় কী? ও হচ্ছে অসীম ক্ষমতাধর। ওর হাঁ, দাঁত, নখ, পেশিশক্তি মারাত্মক মানে মেরে ফেলার মতো। এক এক গ্রাসে সে দশ মণ মিষ্টি খায়। তাজা গোটা মানুষকে সে টপাটপ গিলে ফেলে এক এক লোকমায়। রাজ্য সাফ হয়ে যায়। রাজ্যে হাটবাজার বন্ধ হয়ে যায়। চলাচল উচ্ছনে যায়। দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। নেমে আসে ভিক্ষার অভাব। রাত্রে কুকুর কাঁদে। বিড়ালেরও অন্ন জোটে না। এক এক রাত নেমে আসে আর এক এক করে শত শত লোক হাওয়া হয়ে যায়। যায় রাক্ষসের পেটে। এক-দুই রাক্ষস বা রাক্ষসীই লোপাট করে ফেলতে পারে আস্ত আস্ত একটা-দুইটা রাজ্যপাট। ভয়ংকর আক্রমণাত্মক সে। এবং ছলনাময় অথবা ছলনাময়ী সে। ধারণ করতে পারে বহু রূপ। রাজা থাকে নামে মাত্র। রাক্ষস থাকে তার আড়ালে-আশ্রয়ে। দিনে ভালো মানুষের রূপটি ধরে ঘুরে বেড়ায়। রাতে দেখা যায় তার আসল চেহারা। রাক্ষসের চেহারা। সে চেহারা যে দেখে সে আর ফিরে আসে না। রাক্ষসের খাদ্য হয় সে। রাক্ষসের সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য মানুষ। তাজা মানুষ।

কী বস্তু এই রাক্ষস? কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাতন্ত্রের চলমান রাষ্ট্রীয় টিউটোরিয়ালটি ইউটিউবে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে পারলে রাক্ষস কথাটার উপযুক্ত অর্থ-ইশারা ধরতে পারা যাবে (ইউটিউব = তোমার/আপনার নিজস্ব পিকচার টিউব)। সাহায্য করবেন কলিম খান। সাহায্য করবে তাঁর আবিষ্কৃত ‘ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি’। (দ্রষ্টব্য কলিম খান, ২০০১; এবং কলিম খান, ১৯৯৫।) কলিম খানের অন্তর্দৃষ্টি এবং বুৎপত্তিগত অর্থ নির্ণয়ের সুপ্রাচীন পদ্ধতি-প্রণালীর সাহায্যে নির্ধারণ করা যায় শব্দের প্রকৃত ও বিস্তৃততর সামাজিক অর্থ।

কলিম খান দেখিয়েছেন, পুরাণ ও রূপকথা প্রলাপমাত্র নয়। রাবণের মাথা দশটা এ কথা যেমন আদতে আজগুবি নয়; এ যেমন আসলে রাবণ-যন্ত্রের দশটা দশমুখী ডিপার্টমেন্ট; আজকের রাষ্ট্রযন্ত্রের যেমন হাজারটা চোখ; আইনের হাত যেমন কবর পর্যন্ত পৌঁছায়; সেরকমই উদ্ভট কিছু নয় এই রাক্ষস বস্তুটিও। মানুষের মুখের প্রকৃত/প্রাকৃতিক ভাষাকে সুসংবদ্ধ প্রণালীতে সংস্কার করে প্রাচীন ভাষা-তাত্ত্বিকেরা যে সংস্কৃত ভাষাটা বানালেন তার লক্ষ্য ছিল সমজাতীয় প্রাকৃতিক-সামাজিক-মহাজাগতিক-দার্শনিক ধারণা ও ক্রিয়ারাজিকে একই শব্দে প্রকাশ করতে পারা। তাতে করে কম শব্দে বেশি কথা বলা যায়। সাধারণ সত্যকে সহজে উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং ‘পক্ষী’ মানে যেখানে দুটো পক্ষ আছে পাখি অথবা মামলার বাদী-বিবাদী পক্ষ। ‘অজ’ মানে যার জন্ম নাই আদিতম অজ পাড়া-গাঁ থেকে শুরু করে ব্রহ্মা পর্যন্ত। বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত এবং রাক্ষস তাহলে আর আজগুবি-অবান্তর বিষয় থাকে না। রাক্ষসের বিস্তার এবং রাক্ষসকে মোকাবেলার করার ইতিহাস হয়ে ওঠে আমাদের ভারতবর্ষীয় অঞ্চলের কৌম, কওমি এবং রাজতান্ত্রিক ইতিহাস।

পু
রাণের শ্লোক উদ্ধার করে কলিম দেখিয়েছেন, ‘রাক্ষস’ আর কিছু না সমাজের উদ্বৃত্ত ধনসম্পদ রক্ষা করার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরাই পরে, আস্তে-ধীরে ‘রক্ষস্’-এ পরিণত হয়, চুপিসারে মেরে দিতে থাকে জনগণের যৌথ ধন, সমাজের সমূহ সম্পদ। রক্ষকের ভক্ষকে পরিণত হওয়ার গল্প তার মানে পুরাতন, পৌরাণিক, সুপ্রাচীন। প্রথমে মুখের শ্লোকে, শ্রুতিধরের মাধ্যমে, পরে লিখিত পুঁথিতে আশ্রয় পায় এই গল্প। রচিত হয় রূপকথা। সে কথায় সামাজিক-ঐতিহাসিক রূপ প্রকাশিত হয় বৈকি! খোদ রাজ্য-রাষ্ট্রের অস্তিত্বই আক্রান্ত হয় রাক্ষসের দন্তনখরে। প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে থাকে রাক্ষসতন্ত্র। রাক্ষস-কবলিত হয়ে পড়ে রাষ্ট্র স্বয়ং। রাষ্ট্রের বদলে এবার রাষ্ট্র-রাক্ষসের দেখা পেতে শুরু করি আমরা। প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মানুষ। রাষ্ট্র-রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচার লড়াইয়ের ইতিহাসই রূপকথার অন্যতম রূপ বটে। আজকের রাষ্ট্র-বাস্তবতায় পদ্মাসেতু-তহবিলের কয়েক শ কোটি টাকা এক গ্রাসে গিলে ফেলার ঘটনা যদি দেখেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে এক ২০১৩ সালের ৩৬৫ দিনের ভেতরে ৫০০-র বেশি তাজা মানুষের খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা যদি খেয়াল করেন, তাহলে বুঝবেন ‘রাক্ষস’ নামের আজব এ বস্তুটি আসলে কী বস্তু। এ হলো কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রক্ষমতা-প্রণালী তার হাজারটা ধাতব-বন্দুকীয় নখদন্ত-হুংকার।

বতিচেল্লি, বুয়োনারঁতি, দ্য ভিঞ্চি, রুশো, রাফায়েল, ভলতেয়ার, ভিক্তর হুগোদেরকে মানুষ আকাশ থেকে পেড়ে নিয়ে এসে পাঠ করেন নি। রাজা, চার্চ ও রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান কর্তৃত্বতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিল তিল দাঁড়াতে হয়েছে মানুষকে। চিন্তা, সমালোচনা ও বিচারবুদ্ধির স্বাধীনতার উদ্ধত-অবাধ্য-সার্বভৌম চিন্তাধারা স্বর্গ থেকে আসে নি। রাষ্ট্র-রাক্ষসের হাঁ থেকে ব্যক্তিমানুষের রক্ষাকবচ অর্জনের পৌরাণিক-আধুনিক অজস্র লড়াই ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে মনুষ্য-স্বাধীনতার গাথা। সামন্ত-জমিদার-রাজা-রাণী-রাজপুত্রদের রাষ্ট্র ও রাজ্যপাটের ‘ঐশ্বরিক’ ও সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যক্তি-মানুষকে রক্ষা করার উপায়-পদ্ধতি আবিষ্কারের এবং প্রতিষ্ঠার লড়াই-ই মনুষ্য-রেনেসাঁর পুরাণ রচনা করেছে। ‘জেনারেল উইল’-এর [তথা ‘জনসাধারণের ইচ্ছা’র] নামে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক মহারাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের নামাবলীর আলখাল্লার আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে ক্ষুদ্র ব্যক্তি-মানুষ এবং তার চিন্তা, বিবেক ও প্রকাশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে কীভাবে সুরক্ষিত-সুপ্রতিষ্ঠিত রাখা যায় সেই চিন্তাই ছিল ফরাসী বিপ্লবের ‘সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা’র চিন্তাধারা। রাষ্ট্রকে কেমন করে সংকীর্ণ ‘রাষ্ট্রকর্মের সীমা’র মধ্যে আটকে রাখা যায় যেন সে টপাটপ গিলে ফেলতে না পারে তাজা তাজা আস্ত প্রাণ তার সাধনাই ছিল ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের সাধনা। সেই সাধনার পথ ধরেই আজকের গণতন্ত্রের বিকাশ।

আজকের ক্যাসিনো-কর্পোরেট-ক্যাপিটালিজমের রাষ্ট্র-রাক্ষসীয় কর্তৃত্বতন্ত্র নিজ অস্তিত্ব রক্ষার্থে ফ্যাসিবাদে ফিরে যেতেও আটকাবে না। সে লক্ষণ ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এ শুধু বাংলাদেশের মামলা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘টিপার্টি-আন্দোলনে’র মাথাচাড়া দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন নোম চমস্কি। জার্মান ফ্যাসিবাদের বিপুল জনসমর্থিত কার্যক্রম তাঁর স্মৃতিতে অম্লান। এ বিপদ আমাদেরকে বুঝতে হবে। আমাদেরকে ভাবতেই হবে: রাষ্ট্র তো যুদ্ধাপরাধ সামলাবে, রাষ্ট্র সামলাবে কে?


২৫.৩ রাষ্ট্রপ্রণালীর সপক্ষে গণবৈধতার দৃশ্যমান অভাবের বিপদ


নবতর রাষ্ট্রপ্রণালীতে গণতন্ত্র, জনপ্রতিনিধি-নির্বাচন, মিডিয়ার স্বাধীনতা, বিরোধী দল ও মতের সুরক্ষা ইত্যাদি ধারণা নতুন করে সংজ্ঞায়িত হতে শুরু করেছে বাংলাদেশে। পাঁচ বছরে এক দিন নগনের ভোট দেওয়ার নামে-মাত্র যে অধিকারটুকু অর্জন করতেই আমাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশের বলতে গেলে অর্ধেকটা সময় খরচ করতে হয়েছে, খরচ করতে হয়েছে শত-হাজার মানুষের জীবন, সেই ভোটাধিকারটুকু পর্যন্ত বর্তমান শাসকশ্রেণীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে অসহনীয় মাত্রার বিপজ্জনক। সিটি কর্পোরেশনসমূহের নির্বাচনগুলোতে যে শাসক-জোট লজ্জাজনকভাবে হেরেছেন সেই শাসকজোটই বিনাভোটে-বিনাভোটারে নিজেদের রাষ্ট্রক্ষমতা নবায়ন করেছেন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাঅব্যাহত রাখার নামে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তরকরার প্রক্রিয়া কায়েম করার নামে। এ বড় বিপজ্জনক ঘটনা। সংবিধান আর গণতন্ত্রের এ সত্যি নতুন সংজ্ঞা যদিও নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মতো নতুন এ নয়। এই দুর্ভাগা দেশে এর আগে সামরিক শাসকদের বুটের নিচে সংবিধান স্থগিত করার মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্র। যেকোনো মূল্যে সংবিধান সমুন্নত রাখার সাংবিধানিক শপথ গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বন্দুকের নলের সম্ভাব্য অনলের কথা চিন্তা করে ‘আইনতহয়ে উঠেছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকসেই দুঃসময় পার হয়ে যায় নি দেখা যাচ্ছে। জমিদারির গণতন্ত্র ওরফে রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের আর্থরাজনৈতিক কড়ি-বরগা-রূপকাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে, সুরক্ষিত রেখে, এমনকি সেটিকে আদৌ কোনো আলোচ্য হিসেবে গণ্য না করার গ্যারান্টি অব্যাহত রেখে এগিয়ে গেলে পশ্চাদমুখী অগ্রযাত্রাই নিশ্চিত হয়।

নগণ ভোট দিতে পারে নি; মোটেও তাঁদের ভোটের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন নি মহাক্ষমতাধর মহাজোট-বাহাদুর; গুলো বড় কথা নয়। জনগণের ভোটে কারই বা কী এসেছে গেছে কবে? যাঁদের কালো টাকা আছে, কালো ক্ষমতা আছে, চিরকাল তাঁরাই জনগণের ঘাড়ে চেপে বসা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিতঘোষিত হয়েছেন। আজ যিনি শাদা-পার্টি কাল তাঁরই গাধা-পার্টি থেকে মনোনয়ন পেতেও তো জনগণের ভোট লাগে নি কোনো দিন। ভোট-ভোট-গণতন্ত্র যেটা আছে সেটা রাবার-স্ট্যাম্প-গণতন্ত্র ছাড়া কিইবা এমন! মহাজোটের যেটা সাম্প্রতিক বৈশিষ্ট্য সেটা হলো: এই রাবার-স্ট্যাম্পটাও তাঁদের আর লাগছে না। আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক পরাশক্তি, জাতিসংঘ, সেনাবাহিনী ও মিডিয়াকে ম্যানেজ করাটাই ক্ষমতায় থাকার আসল যোগ্যতা ছিল এবং আছে ভোট সেই নেপথ্য ম্যানেজমেন্টের প্রকাশ্য প্রদর্শনী মাত্র। ঘটনা হলো: এসব ম্যানেজমেন্টে আওয়ামী লীগের মহাজোট একশতে নিরানব্বই-ই পেয়েছেন বলতে গেলে। সুতরাং তাঁরা ক্ষমতায় থেকে যেতে পেরেছেন বিদ্যমান পাওয়ার-পলিটিক্সের সর্বদলীয় নীতিবোধ মোতাবেক এতে কোনো আপত্তি করার সুযোগ দেখি না। বাকি থাকে প্রকাশ্য ভোট-প্রদর্শনীটুকু। এতদিনকার সেই পঞ্চবার্ষিক প্রদর্শনীর বিকল্প হিসেবে নতুন যে গ‌্জিবিশন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রায় সর্বদলীয়ভাবে (যথা বিরোধীপক্ষ কর্তৃক স্কুলঘর পোড়ানো, প্রিসাইডিং অফিসারকে মেরে ফেলা, হিন্দুদেরকে হিন্দুস্তানে হিজরত করার সশস্ত্র-সরক্ত-সধর্ষণ উপদেশ প্রকাশ করা ইত্যাদি প্রভৃতির বিপরীতে একক পুলিশ-বাহিনী আর বিডিআর-বিজিবি-র‌্যাব-সমৃদ্ধ যৌথবাহিনীর বুলেট-বন্দুক-বলপ্রয়োগে ব্যাপক এগ‌্জিবিশন), সেটাই বা কী এমন খারাপ হয়েছে!

হ্যাঁ
, এগুলো বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে: সবাই মিলে ভোট দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে একটা জনসম্মতি/গণবৈধতার অনুভূতি অর্জিত হয় সেই জিনিসটাই খোয়া গেছে সবার অলক্ষ্যে। এতেই হয়েছে বাংলাদেশের আসল ক্ষতিটা। গণতন্ত্রের মঞ্চ-মাইক-মুরুব্বি-মুখপাত্র-মিডিয়াবৃন্দ এই জনসম্মতি/গণবৈধতার কথা আলাদা করে এলান করেন নাই কোনো দিন সত্য কিন্তু উক্ত জনসম্মতি নামক বস্তুটা কমবেশি ছিল বলেই আমাদের বিকলাঙ্গ গণতন্ত্রকেও দেখতে সুন্দর লাগত। এই সৌন্দর্য ছিল তার প্রকৃত শক্তি। সেই শক্তির বিকল্প হিসেবে কোনো এক-এগারো-এমার্জেন্সি কিংবা সেনাসমর্থিত সরকার কিংবা সামরিক শাসন জারির দরকার যে পড়ে নি সেটাও মহাজোট-সরকারের বিশেষ কৃতিত্ব বটে। এবার সেই শক্তিটাকে সরিয়ে তার জায়গায় বসেছে আইন-আদালত-সংবিধান আর অতিসশস্ত্র পুলিশ ফোর্স। পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে এই যে, হাত থাকতে মুখে কথা হবে না। বন্দুক থাকতে লাঠালাঠি কীসের! দেশে থাকবেন সন্ত্রাসী, আর থাকবেন পুলিশ অন্য কেউ থাকবেন না। অবস্থা এমন যে হয় তুমি সন্ত্রাসী, নয় তুমি পুলিশ (হয় তুমি আমেরিকার পক্ষে, নয় তুমি আল কায়দার পক্ষে)। মাঝখানে অন্য কোনো কায়দা থাকবে না। সক্কলেই থাকবেন বেকায়দায়। পাবলিকের স্পেস বলে কিছু থাকবে না। কারণ দেশে এখন লাগাতার জরুরি পরিস্থিতি। দেশের এই দুর্দিনে এখনও যারা বুদ্ধি-বিবেক হারিয়ে ফেলে নি, বরং নীতিবোধের অনাকাঙ্ক্ষিত আবদারের পাল্লায় পড়ে হয়-আমি-নয়-তুমির এপক্ষ-ওপক্ষ কোনো পক্ষকেই প্রাণ খুলে সমর্থন করতে যারা পারছে না, তারা সব গোল্লায় যাক! তারা সব ছদ্মবেশী দালাল! তারা সব চরম সুবিধাবাদী! মোনাফেক! এরাই আসল কালপ্রিট! এই হচ্ছে সুশীল-সামরিক-গণতন্ত্রের জন্য নিবেদিতপ্রাণ সর্বপক্ষের সর্বদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শুভবোধ।

চাইলে আপনি একে
যুদ্ধ-গণতন্ত্র, নামান্তরে জঙ্গি-গণতন্ত্রকারেও উপলব্ধি করতে পারেন। (জঙ্গি—‌>জঙ্গ—‌>যুদ্ধ—‌>সমর—‌>সামরিক। এই গণতন্ত্রের এক পক্ষ সামরিক, তো অপর পক্ষ জঙ্গি। পার্থক্য বলতে সামরিকতা মানে সরকারি বন্দুক, আর জঙ্গিবাদ মানে বেসরকারি বোমাবাজি। আ, বেসরকারি বলতে [খন যাঁরা সরকারে নাই কিন্তু] অচিরেই সরকার হিসেবে আবির্ভূত হতে ইচ্ছুক যাঁরা।) আন্তর্জাতিক উদাহরণস্বরূপ এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রও তো এক প্রকার সদাসামরিক-গণতন্ত্রই বটে! কোথাও না কোথাও যুদ্ধ বাধানো ছাড়া তা বাঁচতে পারে না। এই যুক্তিপ্রণালীতে মার্কিন কর্পোরেট অর্থনীতি আসলে সদা-যুদ্ধ-অর্থনীতি। আগে বাড়ে বাণিজ্যজাহাজ, পিছে তাড়ে রণতরী। আগে আগে বাণিজ্যদূত, পিছে পিছে রাষ্ট্রদূত। এই মডেলে রাষ্ট্র-বাণিজ্য মানে যুদ্ধ-বাণিজ্য।

রাষ্ট্র
-বাণিজ্যের যুদ্ধ-জঙ্গনামাসমৃদ্ধ এই প্রকার সদাসামরিক-গণতন্ত্রের সদাসঙ্গী আমাদের নিওলিবারাল (ওরফে কাছাখোলা) বণিক-কর্পোরেট-মিডিয়া-সঙ্ঘের লাব্বায়েক আওয়াজও কি গরহাজির আছে? আক্কেলজ্ঞানওয়ালাদের জন্য অবশ্য নবসংজ্ঞায়িত মিডিয়া-স্বাধীনতার ইশারাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ মিডিয়ার স্বাধীনতা তো থাকবেই আমরা মিডিয়াকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছি কিন্তু তাই বলে কি প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং টেলিভিশনের টকশো-স্বাধীনতার বাড়াবাড়ি নিয়ে কথা বলতে পারবেন না? তাঁরও তো বাকস্বাধীনতা আছে! সুতরাং দুই মিনিটের মধ্যে আমরা শাপলা-সমাবেশ নিয়ে বাড়াবাড়িকারী দুই টিভি-চ্যানেল সিলগালা করে দিতে পারি। দৈনিক মার দেশ’ ও ইনকিলাব-র বাড়াবাড়ি-করা ছাপাখানা সিলগালা করে দিতে পারি। এর জন্য বিশেষ ক্ষমতা আইন লাগে না আর। আমরা তো কোনো মিডিয়াকে নিষিদ্ধঘোষণা করি নি! এই সরকার গণতান্ত্রিক সরকার। দেশের মঙ্গলের জন্য যা কিছু দরকার, করবে এই সরকার। দরকার হলে সর্বোচ্চ কঠোরতা প্রদর্শন করবেন তাঁরা। মদদ জোগাবেন আমার দেশ দেশের ক্রান্তিকালে কাবাঘরের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মের আলোকচিত্র নিয়ে ইয়ার্কি করতে পিছপা হবেন কেন তাঁরা? তাঁদের কি দেশপ্রেম নাই? নইলে বাংলাদেশ যে ভারত হয়ে যাবে! সরকারকে সর্বচ্চ শিখরে আরোহন করতে সাহায্য করবেন ইনকিলাবফটোশপ-জালিয়াতি করে ডাহা মিথ্যা গোপন সরকারি নথিপত্র ছেপে সাতক্ষীরায় ইন্ডিয়ান আর্মি ঢুকিয়েই ছাড়বেন তাঁরা! নইলে তাঁদের ভারতবিদ্বেষী দেশপ্রেমের প্রেস্টিজ থাকে না। সুতরাং দেশের এই কঠিন অবস্থা মোকাবেলায় সর্বসাধারণের মঙ্গলের জন্য কঠোরতম মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কঠোরতার আশ্রয় নেবেন তাঁরা। এই ধরনের পরাবাস্তব পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলেছে সর্বসম্মত স্বৈরতন্ত্রের নবতর শুভবোধ।

স্বৈরতন্ত্র অবশ্যই সাংবিধানিক। স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট তার পরোক্ষ প্রমাণ! স্বৈরতন্ত্র আলবৎ গণতান্ত্রিক। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশিবিরের গণইচ্ছার প্রতিফলনস্বরূপ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ! (সর্বজনের শাহবাগ আর পঞ্চ ম-এর গণজাগরণ মঞ্চ-কমিটি যে একদমই আলাদা পদার্থ সে কথা বলেছি অন্যত্র কদিন আগে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সাংস্কৃতিক উৎসবে শাহবাগের স্বাধীনতাই শাহবাগের পথনামের রচনায়। আপাতত শুধু মনে রাখলেই চলবে যে সর্বজনের শাহবাগ মানে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার সর্বজনীন ইনসাফ-অনুভূতি; আর পঞ্চ ম বলতে মঞ্চ-মাইক-মিডিয়া-মুরুব্বি-মুখপাত্র।) এখনকার মতো আখেরি কথা হচ্ছে: স্বৈরতন্ত্র উজ্জীবিত খোদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। যে ভোটাভুটি রাজাকার-আলবদর তথা বিএনপি-জামাতকে জয়ী করবে সেই ভোটাভুটি দিয়ে আমরা কী করব! অতএব আমরা একটা সদাপ্রস্তুত পুলিশী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হয়ে উঠছি। মহা-সরকার তার কাণ্ডারি, মণ্ডপাকানো সরকারবিরোধীরা তার সুপ্রতিজ্ঞ সহায়তাকারী। বিএনপি-জামাতের আত্মঘাতী রণনীতিই সরকারকে মহা-সরকার হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে, উসিলা-অসিয়ত সরবরাহ করেছে। তাঁরা মনে রাখেন নি: জামাত-জেএমবি-জনযুদ্ধ-জঙ্গনামা আছে বলেই চিতা-কোবরা-র‌্যাব জাতীয় ‘কিলিং স্কোয়াড’ (হিউম্যান রাইটস ওয়াচ) ওরফে যমদূত-বাহিনীর (‘ওপরে রব নিচে র‌্যাব’ হুমায়ূন আহমেদ) বৈধতা আছে জনমনে। কিন্তু ওপরে যে আপামর জনসম্মতি/গণবৈধতার কথা বললাম আওয়ামী মহাজোটের বিনাভোট-বিনাভোটার নির্বাচন তার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। খোদ রাষ্ট্রের তলা থেকে সরে যেতে শুরু করেছে বিনির্মিত বৈধতার বালুরাশি। যে বিরাট [প্রগতিশীল] জনগোষ্ঠী চেয়েছেন ছলে-বলে-কৌশলে আওয়ামী লীগের রামরাজত্ব রাবণ-বধ করুক, তাঁরা তো মহাখুশি! কিন্তু যে বিপুল জনগোষ্ঠী মাত্র ক-মাস আগের ভোটার-ভর্তি সিটি-নির্বাচনগুলোতে এই মহা-সরকারের বিরুদ্ধে ব্যালট-জাজমেন্ট দিয়েছেন তাঁরা যাবেন কোথায়? তাঁদের অনুভূতি আহত হয়েছে। এই কোটি কোটি মানুষ বিক্ষুদ্ধ হয়েছেন। চোদ্দ সালের চোদ্দ ধারার রাষ্ট্র-সরকার-প্রণালীতে এঁদের জায়গা কোথায়? এঁরা পরিণত হয়েছেন উন্মূল ইলেকটোরেটে। এই উন্মূলতা যে মহাবিপদের বার্তা টুকে রাখছে যুদ্ধ-জমানার দেয়ালে দেয়ালে আমরা তা পাঠ করতে সক্ষম নই বলেই তা কিন্তু অদৃশ্য হয়ে যাবে না! বিদ্যমান রাষ্ট্রপ্রণালীর দৃশ্যমান হতে পারার মতো জনসম্মতি/গণবৈধতা যদি উপায়হীন উন্মূলতার দিকে ধাবিত হতে থাকে, আমাদের আর যাওয়ার জায়গা থাকবে না। সবার আগে উচ্ছন্নে যাবে বাংলাদেশ। নতুন করে ব্যর্থ হবে আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে সুন্দর ঘটনাটা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

 
 
রচনা: জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১৪
প্রকাশ: দৈনিক বণিক বার্তা ১১ই জানুয়ারি, ১৮ই জানুয়ারি ২০১৪, ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৪
দৈনিক সোনার দেশ ১১ই জানুয়ারি, ১৮ই জানুয়ারি ২০১৪, ১লা ফেব্রুয়ারি ২০১৪

 
 
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
 
চার বছর আগের এ রচনাটা লিখিত হয়েছিল ‘ঐতিহাসিক’ ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের সময়। এটা লিখতে শুরু করেছিলাম ২০১৪ সালের ৮ই জানুয়ারিতে। প্রকাশিত হয়েছিল তিন কিস্তিতে। লেখাটা শেষ করতে করতে জানুয়ারি শেষ হয়েছিল। এটা আমার বই অচেনা দাগ-এ সংকলত হয়েছিল। আজ ২০১৮ সালের ৫ই জানুয়ারিতে এসে এটা আবার পড়তে গিয়ে দেখি বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ থেকে গেছে। সেগুলো মেরামত করলাম। এখন এটাকে আমার এই সরন-প্রতিসরণ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার সময় কমা, ঊর্ধ্বকমা, হাইফেন, ড্যাশ প্রভৃতি ঠিকঠাক করে দিলাম। এক-আধটা শব্দের এদিক-ওদিক, তৃতীয় বন্ধনীর ভেতরে দু-চারটা শব্দ যোগ করা, দুই-একটা ‘এবং’ অথবা ‘ও’ যোগ-বিয়োগ-প্রতিস্থাপন করা ইত্যাদি ধরনের পরিমার্জনাও করে ফেললাম। অর্থগত দিক থেকে মূল রচনা সামান্যও এদিক-ওদিক করা হয় নি। মূল বইয়ের পাঠের সাথে মিলিয়ে দেখলেই তা বোঝা যাবে। তার কোনো দরকারও ছিল না।

 

 

 
 
 
 
 
Logo