English | বাংলা
Logo
 

 

হেফাজতে ইসলাম নিয়ে অল্প কয়টা কথা

ফেসবুক-নোট, ২৯-০৪-২০১৩

 

সূচনা-টীকা: এই রচনাটা ফেসবুকে খুব তাড়াহুড়া করে, ফেসবুকে রিফাত হাসানের একটি নোট ("হেফাজতের লংমার্চ: আমার একটি সেক্যুলার ভ্রমণ কাহিনী") পাঠের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে, লেখা হয়েছিল। পৃথক একটা নোট হিসেবে তা আপলোড করেছিলাম ফেসবুকেই। পরে ২৯শে এপ্রিল ২০১৩ তারিখে সেটিকে পরিমার্জনা সম্পাদনা করে, কিছু কথা যোগ করে, নতুন ভাষ্যটাই আপলোড করে রেখেছিলাম। সেটাই এখানে ছাপা হচ্ছে।

 

রিফাত, দুর্দান্ত লাগল আপনার বিবরণীটা। এই ধরনের প্রত্যক্ষদর্শীর একটা বিবরণী চাচ্ছিলাম মনে মনে। কিন্তু কয়েকটা জায়গায় আমি একমত না। আপনি লিখেছেন:

 

আমরা আগেই বলেছি, এদের কোন ইসলামী রাষ্ট্রের দাবী নেই। স্রেফ রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করে তোলারদাবী আছে। এদের দাবীগুলো কোন ফ্যাসিস্ট দাবী নয়। এই সমাবেশের লোকজন বিরোধীদের জবাই জবাই জবাই জবাই কর জাতীয় কোন আধুনিক শ্লোগান দেয় নাই। আমার চোখে একবারও পড়ে নাই। (রিফাত হাসান, ২০১৩)

 

এ সব নিয়ে আমার কথাগুলো অতি সংক্ষেপে পয়েন্ট আকারে নিচে দিলাম:

 

১। ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণা (যদিও কোরানে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাই নাই), শরিয়া আইন (এটা হযরত মুহাম্মদ সাঃ প্রণীতও নয়, কোরান-প্রণীতও নয়, পরবর্তী কালে রচিত) ইত্যাদি এই হেফাজত আন্দোলনের সুপ্ত প্রাণ। নাস্তিকদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করাটা শরিয়া আইনের প্রচলিত ব্যাখ্যারই অনুসারী। হেফাজতে ইসলাম একটা রাজনৈতিক আন্দোলন। রাজনৈতিক আন্দোলন মাত্রেই ব্যক্তিস্বাধীনতাবিরোধী (এমনকি নিজের সদস্যদের ব্যক্তিস্বাধীনতারও) এবং ক্ষমতাপিপাসু, ক্ষমতাকেন্দ্রিক। এই লংমার্চ সমাবেশে অসংখ্যবার সরকার-উৎখাতের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

২। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করে তোলার দাবির সাথে মতপ্রকাশের দায়ে মৃত্যুদণ্ড চাওয়াটা মানানসই নয়। লেখাকে লেখা দিয়ে, মতকে মত দিয়ে মোকাবেলা করাই গণতান্ত্রিক স্পিরিট।

৩। ‘জবাই করো’র জঘন্য স্লোগান সরাসরি এঁরা দেন নি ঠিকই, কিন্তু আমি কয়েক ঘণ্টা ধরে সমাবেশের লাইভ সম্প্রচার দেখেছি। প্রচুর বক্তা চরমভাবে চীৎকার করে‘আমরা রক্ত দিতে প্রস্তুত’, ‘আমরা রক্ত দিতে প্রস্তুত’, ‘আমরা রক্ত দিতে প্রস্তুত’ বলে যাচ্ছিলেন। বেশিরভাগ বক্তাই। রক্তদানের উদ্দেশ্য নাস্তিকদের খতম করতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করা। (শাহবাগও বরাবরই রক্তদানে প্রস্তুত: রাজাকারদেরকে খতম করতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করার জন্য।) উপরন্তু, হেফাজতের ঢাকা-চট্টগ্রামের সমাবেশ এবং অন্যান্য বক্তব্যের নিবিড় পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে ‘জবাই’ করার বাসনা, প্রতিপক্ষের ‘টুঁটি টিপে ধরা’র বাসনা তাঁদের মধ্যে ভীষণ ও মারাত্মক রকমের প্রবল।


ভাববেন না যে আমি আলাদা করে হেফাজতের হুজুরদের দোষ দিয়ে আনন্দ পাচ্ছি। যে সমাজে সুশীল সমাজের বড় হুজুরদের সবচেয়ে প্রিয় পত্রিকায় ক্রিকেট খেলার মতো আনন্দময় ও বন্ধুত্বপূর্ণ একটা ঘটনার রিপোর্ট লিখতে গিয়ে পর্যন্ত রিপোর্টার লিখতে পারেন ‘তবু ৬৫ রানে ৩ উইকেট তুলে নেওয়ার পরও টুঁটি চেপে ধরা যায় নি জিম্বাবুয়ে ব্যাটসম্যানদের’ (‘বাংলাদেশের দারুণ শুরুর পর সেই টেলর’, তারেক মাহমুদ, হারারে থেকে, প্রথম আলো, ১৮ই এপ্রিল ২০১৩, প্রথম পাতা) সে সমাজের রাজনীতিবিদদের কাছে আর কীইবা প্রত্যাশা করা যেতে পারে?

আর প্রতিপক্ষকে জবাই করার বাসনা কোনো ‘আধুনিক’ বাসনা নয়। এটা রাষ্ট্র-রাজতন্ত্রের সমান বয়সী। এবং সেই অর্থে মহাকর্তৃত্বপরায়ণ ‘সভ্যতার’ সমান বয়েসী একটা ধারণা। এই ধারণার জন্য বিশেষ করে ‘আধুনিক’দের দায়ী করার সুযোগ নাই। ‘আধুনিকতা’র অনেক সীমাবদ্ধতা আছে বটে। কিন্তু রেঁনেসার গর্ভজাত এই বস্তুটির ভালো দিকের কোনো শেষ নেই। ‘আধুনিকতা’কে এতটা ঢালাওভাবে কটাক্ষ করা কাজের কথা নয়।

৪। নারী-সাংবাদিকেরওপর হামলাকে হেফাজতের কর্মীদের বা তাঁদের মধ্যে ঘাপটি-মারা অন্য কারো হামলা বলে বিশ্বাস করাটাই যথেষ্ট নয়। এই বিশ্বাসকে পাবলিকলি প্রচার করার সময় আসলে কারা হামলা করেছেন, বা আদৌ হামলা হয় নি বলে, প্রমাণকরার দায়ও বর্তায়।

৫। নারী-সাংবাদিক না হোক, খোদ আপনার চট্টগ্রামে এঁরা একাত্তর টিভির ওপর রীতিমতো হামলা করেছেন। তার ভিডিও ফুটেজ আমি দেখেছি।

এ ছাড়া সার্বিকভাবে বললে, হেফাজতের রাজনৈতিক কৃষ্টির কতকগুলো মৌলিক জায়গার সাথে (এই লংমার্চে যা দেখা গেছে) সরকার, রাষ্ট্রও সকল রাজনৈতিক দলের পার্থক্য কম। সংক্ষেপে একটু বলি:

 

(ক) এঁরাও ভ্যানগার্ডে বিশ্বাস করে, জনতাকে স্রেফ স্বকীয় চিন্তাবিমুখ অনুসারী-অনুগত বানাতে চান, ওঁরাও চান।

(খ) এঁদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কতিপয়-গুটিকয় নেতা-হুজুর, ওদেরও তাই।

(গ) এঁরাও দণ্ডবিধিকে সর্বোচ্চ নীতিনৈতিকতা মনে করেন, ওঁরাও তাই।

(ঘ) এঁরাও রাষ্ট্রকে নিবর্তনমূলক করে তুলতে চান, ওঁরাও তা-ই চান।

(ঙ) এঁরাও মতবাদকে ‘চূড়ান্ত সত্য’ মনে করেন, ওঁরাও তাই।

(চ) এঁরা এ দেশকে ‘মুসলমানের দেশ’ মনে করেন, আর ওঁরাএ দেশকে বাঙালি-সেকুলার-আধুনিকদের দেশ মনে করেন। উভয়ই স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যবিরোধী। উভয়ই একপেশে।

(ছ) উভয়ই মুখে মুখে অহিংস, কিন্তু দাবি না মানলে সহিংসতার হুমকি স্ট্যান্ডবাই থাকে। উপরন্তু হেফাজতে ইসলাম হিন্দুদের শ খানেক মন্দিরে এবং অগুনতি বাসাবাড়িতে হামলা-অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির সামান্য মৌখিক নিন্দাটুকুও করেন নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও তাঁরা চান নি।

(জ) উভয় পক্ষের কেউই আলোচনা সংলাপ-সমঝোতা-বোঝাপড়া-সহিষ্ণুতায় আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন না। সত্যিকারের গণতন্ত্র এবং/কিংবা হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) মদিনা সনদ ও হুদায়বিয়ার সন্ধির আলোচনা-সংলাপ-সমঝোতা-বোঝাপড়া-সহিষ্ণুতার স্পিরিটের কোনোটাতেই এঁরা কেউই আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন না।

(ঝ) উভয়েই মিথ্যা প্রচারে, মানে প্রচারণায়, বিশ্বাস করেন। তার চর্চাও করেন। মিথ্যা বলায় উভয়েই পটু। অন্য পক্ষেরটা তো সবাই জানেনই, সারা বছর ধরেই তা দেখা যাচ্ছে। হেফাজতের নেতাদেরকে দেখলাম অনেক অনেক বার করে বলতে যে এই সরকার নাস্তিকদের সরকার। এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। খোদ রাষ্ট্রপ্রধানকেও তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে নাস্তিক আখ্যায়িত করলেন বারংবার। এই দাবিও ডাহা মিথ্যা।

 

রিফাত, আপনার বাকি প্রায় সব পর্যবেক্ষণ, বিশেষত হেফাজতের লংমার্চে যোগদান-কারীদের আপনার দেখা অংশটুকুর মধ্যকার আপাত-ইতিবাচক গুণাবলীগুলোর পর্যবেক্ষণের সাথে আমি মোটামুটি একমত। আমি কিন্তু ‘হেফাজতের লংমার্চে যোগদানকারীদের আপনার দেখা অংশটুকুর’কথা বলছি। রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে হেফাজতে ইসলামের প্রতি এইসব পর্যবেক্ষণ আমার তরফে প্রযোজ্য না। আর এইসব গুণাবলীকে ঢালাওভাবে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ হিসেবে আগাম গ্রহণ না করে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বিচারবুদ্ধি-বিশ্লেষণ সহকারে বোঝা দরকার আছে। এই জন্যই এইসব গুণাবলীকে আমি আপাতত ‘আপাত-ইতিবাচক’ বলে আখ্যায়িত করেছি।

আরো একটা কথা, রিফাত। সরকার, রাষ্ট্র ও সকল রাজনৈতিক দলের যেসব মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কথা ওপরে বললাম, এমনকি শাহবাগের মঞ্চ-মাইক-মুরুব্বি-মুখপাত্রদের মধ্যেও সেগুলো পুরো মাত্রায় দেখা গেছে (‘ক’ এবং ‘ঝ’ বাদ দিয়ে)। এসব নিয়ে অন্যত্র লিখেছি আমি। [সেলিম রেজা নিউটন, ২০১৪] কিন্তু শুধু এগুলোই শাহবাগের আসল বৈশিষ্ট্য নয়। শাহবাগের সুবিশাল জনসমুদ্রের অজস্র স্বতন্ত্র কেন্দ্রকে ঘিরে জমায়েত হওয়া মানুষের মধ্যে দেখা গেছে এসবের ঠিক বিপরীত দিকগুলো। এর সত্যিকারের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য আছে সুপ্রচুর। সেগুলোও আমার অন্যান্য রচনায় বলেছি। সামনেও আরো বলার দরকার পড়বে। এবং তা এই কারণে যে সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শাহবাগের পথই বাংলাদেশের পথ। আমাদের মুক্তির পথ।সেই পথ থেকে উপরে বর্ণিত কাঁটাগুলো অপসারণ করে একে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় নবপ্রাণে-নবরূপে উজ্জীবিত করাটাই আমাদের এখনকার কাজ। শাহবাগের পথই আমার পথ। হেফাজতের পথ আমার পথ নয়।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ দুর্দান্ত একটি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী পেশ করার জন্য।

 

ফেসবুক-নোট: এপ্রিল ২০১৩

 

রিফাত হাসান (২০১৩),

 

সেলিম রেজা নিউটন (২০১৪), "শাহবাগের স্বাধীনতাই শাহবাগের পথ", কুমিল্লা সংস্কৃতি উৎসব ২০১৪-এ উপস্থাপিত সেমিনার-প্রবন্ধ, অষ্টপ্রহর-ম্যাগাজিন, দৈনিক বণিক বার্তা, তিন কিস্তিতে মুদ্রিত: ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ২২শে ফেব্রুয়ারি ২০১৪। এ ছাড়া, বর্তমান প্রবন্ধের চতুর্থ দাগের কয়েকটা রচনা দ্রষ্টব্য। এ রচনাটি লেখকের অচেনা দাগ: সম্পর্ক সংগঠন স্বাধীনতা বইয়ের ৩৪-সংখ্যক রচনা।

 

ফেসবুক-নোট, ২৯-০৪-২০১৩

 
 
 
 
Logo