English | বাংলা
Logo
 

 

বন্দুক দিয়ে টেরোরিস্ট অ্যাটাক থামানো যায় না

অপার বাংলা, ২৭-০৪-২০১৬

 

রাজনীতি থেকে দূরে, সংস্কৃতির কাছে

কথার শেষ নাই। কথা— শুধু কথা কথা কথা কথা কথা। ‘কেমন মানুষ ছিলেন অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দীক’ (আরকেএস), তাই নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। নিরিবিলি মানুষ আরকেএস। চলাফেরা নিজের মতো। নিজের কাজকর্ম নিয়েই তাঁর থাকা। রাজনীতি-টাজনীতির ত্রিসীমানা থেকে দূরে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো রাজনৈতিক ভাগাড়ে লাল-নীল-হলুদ-কমলা-গোলাপী রঙের রাজনীতিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করে শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে থাকা, পড়া, পড়ানো ইত্যাদি কিন্তু কঠিন কাজ। অনেক কঠিন। অবলীলায় সে কাজ করেছেন অধ্যাপক আরকেএস দীর্ঘকাল।

আরকেএস একজন ‘সংস্কৃতিমনা’ লোক ছিলেন বলে বলে বেড়াচ্ছে লোকজন। তারঁ হত্যাকাণ্ড ‘সংস্কৃতিমনা’ লোকদের ওপর কিরকম প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়েও জল্পনা চলছে। কিন্তু ‘সংস্কৃতিমনা’ লোক আর ‘সংস্কৃতিবিহীন’ — লোক এরকম আমি বুঝি না বা ভাগ করতে পারি না। ফলে এটা আমার জন্যে বলা কঠিন। কিছু লোক যদি ‘সংস্কৃতিবিহীন’ হয়, ‘শিল্পবোধহীন’ হয় তো তাঁদেরকে নিকেশ করে দিলেই চলে! দেওয়াও যায় যুক্তিতর্কের বলে! এবং উহাকেই ফ্যাসিবাদ বলে। (এ নিয়ে তর্ক করতে চাইলে দ্রষ্টব্য: সেলিম রেজা নিউটন, ‘কর্তৃত্বতন্ত্র শিল্পবোধ স্বাধীনতা’, অচেনা দাগ, ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১৩।)

আমি ফ্যাসিবাদী নই। বরং জরুরি বিষয় আমার এটা মনে রাখা যে, রাজনীতি জিনিসটাই সংস্কৃতির শত্রু। রাজনীতি দিয়ে সংস্কৃতি হয় না। রাজনীতি হলো গিয়ে লোক-ঠ্যাঙানো, লোক-ফুসলানো কাজ। সংস্কৃতির কাজ রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে মানুষের স্বাধীনতা কায়েম করার প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসা। (এ নিয়ে কথা বাড়ানোর আগে দ্রষ্টব্য: সেলিম রেজা নিউটন, ‘রাজনীতি সংস্কৃতি কারাগার’, অচেনা দাগ, ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০১৩।) সংস্কৃতি মানে সৃজনশীলতা। মানুষের সহজ-স্বাভাবিক সৃজনশীলতা। আর, স্বাধীনতাই সৃজনশীলতার ধাত্রী।
 

আমলাতন্ত্র সবসময় রাষ্ট্রের হাওয়া বুঝে চলে

আরো আছে। ‘ব্লগার হত্যা’র সাথে অধ্যাপক রেজাউল হত্যার ‘মিল’ আছে বলে পুলিশ মন্তব্য করেছে। সাংবাদিকেরা তাই নিয়ে কানাকানি করে চলেছেন। আমাদের যাবতীয় অথরিটি — রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তারা, আমাদের পুলিশ এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা-এজেন্সির কর্তৃপক্ষ — ঘটনা ঘটতে না ঘটতেই যেভাবে ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেন, তখন আর তদন্ত করা, তথ্য-সংগ্রহ করা, জানা — এগুলোর কোন মানে থাকে না, এগুলো অবান্তর হয়ে যায়। আমাদের বোয়ালিয়া থানার কর্মকর্তা, রাজশাহীর পুলিশের কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার ঘটনা ঘটতে না ঘটতেই বলে দিলেন যে— এটা এ রকম মনে হচ্ছে, ও রকম মনে হচ্ছে। এখানে পাঁচটা মাথা কাজ করলে পরে পাঁচ রকম মনে হতে পারত। কিন্তু উনাদের সবার কেন একই রকম মনে হয় আমি বুঝি না। তোতা পাখির মতো বলতে থাকেন কীভাবে?

মুখস্থ প্রশ্ন: ‘আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায় কতটা?’ অমুক ঘটনার মতো মনে হচ্ছে বললেই তো আর পুলিশের দায় ফুরিয়ে যায় না, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায় ফুরিয়ে যায় না! আমাদের দায়টা হচ্ছে তথ্য জোগাড় করা এবং কী তথ্য তাঁরা পেয়েছেন তা জনগণের সামনে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা, যেন আমরা বুদ্ধি খাটিয়ে বিবেচনা করে দেখতে পারি, যা পুলিশ বলছে সেগুলো কতটুকু গ্রহণযোগ্য।

সাথে প্রশ্নের লেজ: ‘পুলিশ কি দায় এড়ানোর জন্য এমনটা করছে?’ আমি ঠিক জানি না। আমলাতন্ত্র একটা অদ্ভুত জিনিস। আমলাতন্ত্র কর্তার মন বুঝে চলে। আমলাতন্ত্র সবসময় রাষ্ট্রের হাওয়া বুঝে চলে। হাওয়া যেরকম, কর্তাদের মন যেরকম — উনারাও সেই বুঝেই কথা বলছেন।
 

একটু-আধটু তথ্য তো লাগবে— যাকে বলে ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট!

বাতাসে ষড়যন্ত্র সুস্থিত হয়ে আছে: ‘একটি ইস্যুকে চাপা দেওয়ার জন্য অন্য ইস্যু তৈরি করা হয় বলে মনে করেন অনেকেই— অধ্যাপক রেজাউল হত্যার ক্ষেত্রে এর কোনো মিল আছে ...’। উফ! এগুলো অনুমান মাত্র যে, সরকার বা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা জনগণের চোখ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরানোর জন্য নানা ধরনের ঘটনা নিজেরাই ঘটান— এই জাতীয় অনুমানের পেছনে তাঁদের কোনো যুক্তি নেই তা বলছি না। কিন্তু যুক্তি দিয়ে আর অনুমান দিয়ে তো আর ঘটনা বোঝা যায় না। যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের তদন্ত করতে হবে, তথ্য জোগাড় করতে হবে। তথ্য সংগ্রহ না করতে পারলে আমি কীভাবে বলব কে, কীভাবে, কার মনোযোগ সরানোর জন্য কারা ষড়যন্ত্র করছে।

আমার মতো আহাম্মকের দিকেও ধেয়ে আসে বুদ্ধিজীবিত ‘প্রশ্ন’ (আহা প্রশ্ন!): ‘অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের মতো অধ্যাপক রেজাউল হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস— বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?’ দায় বলি, যা-ই বলি, একটু-আধটু তথ্য তো লাগবে — যাকে বলে ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট! ম্যাটারের খবর নাই এখনও। ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স’-এর টুইটার-অ্যাকাউন্টে আইএস-এর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, আইএস-এর ‘আমাক এজেন্সি’ নাকি দায় স্বীকার করেছে। এখন দেখেন — ‘আমাক এজেন্সি’র কাছ থেকে খবর পেয়েছেন ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স’ গ্রুপ; তাঁরা তাঁদের টুইটার-অ্যাকাউন্টে সেটা জানিয়েছেন — কিন্তু ‘আমাক এজেন্সি’ কারা, তাঁরা কোথা থেকে কাজ করেন, সেগুলো তো আমরা জানি না। এঁদের সম্পর্কে আমাদের নিজেদের মতো করে কিংবা আমাদের দেশের রাষ্ট্রের তরফে সুনির্দিষ্ট কোনো যোগাযোগ বা খবরাখবর জানা নাই। বাকি থাকে এই ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স’ গ্রুপ। এখন ওঁরা কীসের ভিত্তিতে বলছেন, সেটার কোনো বিবরণই কিন্তু আমরা ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স’ গ্রুপের হোমপেজে গিয়ে দেখলাম না। টুইটারের অ্যাকাউন্ট থেকে ওই পোস্টটাই শুধু দেখলাম। সুনির্দিষ্ট তথ্য সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত এ ধরনের তথ্যগুলোকে বা উড়ো খবরগুলোকে বিবেচনা করা কঠিন।

প্রশ্ন খুঁজে পাচ্ছেন না আর সাংবাদিক: ‘আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে আইএস-এর বিষয়টি খুবই গুরুত্ব সহকারে ছাপা হচ্ছে। কেন এটা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন?’ অত সস্তা জিনিস যে ‘গণমাধ্যম’ নয়, সেটা সাংবাদিককেই তো বুঝিয়ে বলতে হবে, তাই না? আমাদের দেশে ‘গণমাধ্যম’ বলে যা পরিচিত তা আসলে কর্পোরেট মিডিয়া। আসলে এগুলো ‘গণ’মাধ্যম না। জনগণের মাধ্যম না। কর্পোরেট মিডিয়াতে দেশের যে ঘটনা সবার মনোযোগ চাচ্ছে বলে তাঁরা মনে করেন, সেগুলো নিয়ে তাঁরা যা প্রয়োজন সেটুকু গুরুত্ব সহকারে ছাপেন। দু-তিন দিন পর সেটুকু ছাপাছাপিও আবার বন্ধ করে দেন। তো উনারা গুরুত্ব দিয়ে কী ছাপছেন কী বুঝে সেটা উনারাই ভালো বোঝেন। বেশিরভাগ নিউজপেপারগুলোর নিউজে তো আইএস-এর দায়স্বীকারের উপযুক্ত কোনো উৎস-সূত্রের তথ্যটুকু পর্যন্ত নাই। ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স’ গ্রুপের কথাটুকুও সবক্ষেত্রে নাই।
 

প্রত্যেকটা মানুষের খুনই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা

সারা পৃথিবীর ‘গণমাধ্যম’ শাসক-এলিটরাই চালান। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খুন হয়ে যাচ্ছেন, লেখক খুন হয়ে যাচ্ছেন— এগুলো এ সমস্ত এলিটদের কাছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ঘটনা, এলিটদের ‘নিজেদের ঘটনা’। আমার কাছেও এটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু আমার কাছে প্রত্যেকটা মানুষের খুনই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে আমাদের সরকার যাঁদেরকে ‘জঙ্গি’ বলে দাবি করছেন— সেসমস্ত ধারার মানুষেরাও তো গত কয়েক বছর ধরে বিপুল মাত্রায় খুন হয়েছেন, এখনও হয়ে চলেছেন। তো, সব খুনই খুন। যদি মনে করি যে, কিছু খুন আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য অথবা যদি মনে করি কিছু খুন আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না; যদি মনে করি, কিছু ভিকটিম আমাদের মনোযোগ পাওয়ার মতো, এবং কিছু ভিকটিম আমাদের মনোযোগ পাওয়ার মতো নয়— তাহলে এখানে খুনখারাবি চলবে। চলতেই থাকবে।

এখানে রাষ্ট্র দিন দিন সর্বাত্মক রকমের স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠছে। এ ধরনের একটা রাষ্ট্র যখন বিপুল পরিমাণে খুনখারাবি, নির্যাতন, ধড়পাকড় ইত্যাদিতে পাইকারিভাবে নিয়োজিত হয়ে পড়ে, যখন বিভিন্ন রকমের মত বিভিন্ন রকমের গোষ্ঠী তাদের ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারে না, তখনই কিন্তু এরকম একটা খুনাখুনির পরিবেশ তৈরি হয়।
 

সরকারের কায়দা, সরকারের ফায়দা

বাংলাদেশের যাবতীয় খুনের দায় সরকারকে নিতে হবে। আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য এবং সার্বিক নিরাপত্তার জন্য মোট কত রকমের বাহিনী আছে তার তালিকা প্রণয়ন করাটাও কঠিন। অনেক বাহিনী আছে, অনেক গোয়েন্দা সংস্থা আছে, তাঁদের পেছনে বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়, এবং এ সমস্ত কিছু নিয়ে সরকার বাহাদুরেরর তরফে এত লম্বা লম্বা চওড়া চওড়া বক্তৃতা — এত সমস্ত তাঁরা করেন — দায়িত্ব তো তাঁদেরকেই নিতে হবে। একটা নাগরিকও যদি খুন হন — তিনি লেখক হোন, কৃষক হোন, আর শিক্ষকই হোন; তিনি ইসলামি রাজনীতি করেন, চরমপন্থী রাজনীতি করেন; আওয়ামী লীগ করেন বা বিএনপি করেন; অথবা রেজাউল করিম সিদ্দিকী সাহেবের মতো কোনো দল না করেন — তিনি যেই হোন না কেন, প্রত্যেকটা খুনের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে এবং সরকারকে নিতে হবে। এভরি ক্রাইম ইজ এ পলিটিক্যাল ক্রাইম, ইভরি প্রিজনার ইজ এ পলিটিক্যাল প্রিজনার, অ্যান্ড এভরি মার্ডার ইজ এ পলিটিক্যাল মার্ডার। পলিটিক্যাল মার্ডার বলতে দলীয় নয়, রাষ্ট্রীয়। পলিটিক্স মানে পার্টি না কিন্তু! পলিটক্সের আসল কাহিনী হচ্ছে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা। কোনো না কোনোভাবে এ ঘটনাগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটে। রাষ্ট্র যদি নিজেদেরকে এতই অসহায় মনে করে, সরকার যদি নিজেকে অসহায় মনে করে, তাহলে তাঁদের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন-আয়োজনের মাধ্যমে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত।

এখন কে আইএস, কে জঙ্গি, তাঁদেরকে যেহেতু আমরা চিনি না, আমরা যেহেতু বাংলাদেশের রাষ্ট্রকে চিনি, সরকারকে চিনি— এটা তাঁদেরই দায়িত্ব যে, কী হয়েছে কেন হয়েছে সেটা খুঁজে বের করা। এবং কী তাঁরা খুঁজে পেলেন সেটার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ্যে — জনগণের সামনে — পেশ করা। তা না হলে আমাদের ধরে নিতে হবে: আমাদের না জানার মধ্যে, আমাদেরকে না জানানোর মধ্যে, এগুলো নিয়ে লুকোচুরি খেলার মধ্যে নিশ্চয়ই এ রাষ্ট্রের এবং সরকারের কিছু না কিছু ফায়দা আছে। আমরা তা-ই ধরে নেব।
 

বন্দুক দিয়ে টেরোরিস্ট অ্যাটাক থামানো যায় না

১৬ কোটি মানুষের নিরাপত্তা কখনো পুলিশ বাহিনী দিতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টেরোরিস্ট অ্যাটাকগুলো থামাতে পারে না। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রে একের পরে এক অ্যাটাক চলছেই। টেরোরিস্ট অ্যাটাক কখনো থানা-পুলিশ, সামরিক বাহিনী দিয়ে থামানো যায় না। যেখানে ঐসব রাষ্ট্রই পারে না, সেখানে আমরা থানা-পুলিশ দিয়ে ক্রাইম বন্ধ করব— এগুলো খুব আজগুবি ধারণা।

আসলে আমরা চাই যেকোনো প্রকারে হোক ক্ষমতায় থাকতে। যাঁরা ক্ষমতায় নেই তাঁরা চান যেকোনো প্রকারে হোক ক্ষমতায় যেতে। ক্ষমতায় যাঁরা আছেন এবং ক্ষমতায় যাঁরা আসতে চান তাঁরা সবাই মিলে দেশটাকে জমিদারের মতো লুটপাট করবেন— এটা তাদের একমাত্র লক্ষ্য। বাকিসব আলাপ মাত্র। বক্তৃতার বুলি। মুখস্ত রাজনৈতিক-মতাদর্শিক বুলি। সর্বপ্রকার রাজনীতিবিদেরই, সকল ধারার সকল রাজনৈতিক দলের নিজের নিজের ভাষায় রচিত মুখস্ত বুলি আছে। তোতাপাখির শেখা বুলি।
 

রাষ্ট্রের ঘাড়ে দায়িত্ব দিয়ে টিভি দেখব আমরা?

এ পরিস্থিতিতে আমার মেয়ে যেন রেপ না হয় সে ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। আমার সমাজকে করতে হবে। রাষ্ট্রের ঘাড়ে যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দিয়ে আমরা এখানে বসে টেলিভিশন দেখব, আর ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করব — এ দিয়ে তো পরিস্থিতি বদলাবে না। যে দেশের মানুষ এখনও সাবালক হন নি, যে দেশের মানুষ এখনও নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নিতে পারেন না, সে দেশের মানুষজনকে নিয়ে তো সরকার, রাষ্ট্র, এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শক্তিশালী এজেন্সিগুলো ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলবেই।

আমাদের নিয়তি বদলানোর উপায় হচ্ছে আমরা কিছু করতে পারি কিনা তা খুঁজে বের করা। নিজেদের বাঁচার জন্য, নিজেদের মঙ্গলের জন্য, নিজেদের বিকাশের জন্য সেখানে মনোযোগ দেওয়া। এই রাষ্ট্র এই পুলিশকে তদন্ত-গ্রেপ্তার-বিচারের দায়িত্ব দেওয়ার কোনো মানেই হয় না।
 

বিচারের নামে হত্যার বদলে হত্যা স্রেফ প্রতিশোধস্পৃহা বাড়ায়

বিচারের নামে হত্যার বদলে হত্যা শুধু পারস্পরিক প্রতিশোধস্পৃহাই বাড়ায়। বাড়াতেই থাকে। আমাদের দরকার সমঝোতা। রাজনৈতিক সমঝোতা। সমঝোতাই প্রকৃত নিরাপত্তা। আপনার প্রতিবেশী এবং আপনি সশস্ত্র অবস্থায় ২৪ ঘণ্টা পার করতে থাকা মানে নিরাপত্তা নয়। নিরাপত্তা মানে শান্তিও বটে। যাবতীয় সশস্ত্র প্রতিশোধপন্থা অশান্তির। হিংসার। চক্রবৃদ্ধি হারে বিকশিত হতে থাকা হিংসার। প্রতিবেশীর সাথে আন্তরিক, সুবিশ্বস্ত সমঝোতাই আপনার আসল নিরাপত্তা। আইএস হোক, আইএসআই হোক, র হোক, রাষ্ট্র হোক, গুণ্ডাপাণ্ডা হোক বা ভাল্লুক হোক — মানুষ রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে যাঁরা হত্যা করেছেন, তাঁদের গোত্রগত নাম যা-ই হোক, তাঁরা আমাদের দেশেরই মানুষ। আমাদেরই আত্মীয় প্রতিবেশী। বিদেশী কেউ এসে এখনও পর্যন্ত খুনাখুনি শুরু করেন নি।
 

রাস্তায় নামতে হবে: খুন হয়ে যাওয়ার আগেই

সেই সমঝোতা অর্জিত হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন খুন না ঘটে, আমার পাড়াতে যাতে খুন না ঘটে, তার দায়-দায়িত্ব-সিদ্ধান্ত যদি গোটা পাড়া নেয়, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত মানুষ নেয়— তাহলে খুনাখুনি চালানোটা কঠিন হয়ে যাবে। আমাদেরকে যাবতীয় রাজনৈতিক দলের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে সামাজিক পর্যায়গুলোতে পাড়া-সভা, মহল্লা-সভা, ওয়ার্ড-সভা, গ্রাম-সভা, বাজার-কমিটি, কিংবা হল-সভা, ক্যাম্পাস-সভা ইত্যাদি প্রভৃতি ধরনের গণকমিটি গঠন করতে হবে।

আমাদেরকে সর্বপ্রকার ভয় কাটাতে হবে। খুন হয়ে যাওয়ার আগেই রাস্তায় নেমে আসতে হবে। রাস্তা মানে মিছিল মিটিং নয়। রাস্তায় নামা মানে নিজের নিজের মহল্লার-এলাকার-অঞ্চলের রাস্তায় টহল দিতে হবে। আমাদেরকে এবার নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নিতে হবে। “যার যা আছে তাই নিয়ে” টহলে নামতে হবে। দিবারাত্রি টহল। সমাজকে জাগ্রত হয়ে উঠতে হবে। সদাজাগ্রত। রাষ্ট্র-বাহাদুর, সরকার-বাহাদুর, পুলিশ-বাহাদুর (তাঁরাও আমাদেরই আত্মীয়-পরিচিত-প্রতিবেশী) আমাদেরকে — সমাজশক্তিকে — যতটা পর্যন্ত সাহায্য করবেন ততটা পর্যন্ত প্রশংসা পাবেন, আর যেখানে তাঁরা আমাদের স্ব-নিরাপত্তা রক্ষার স্ব-বন্দোবস্তে অন্যায় হস্তক্ষেপ করবেন সেখানে তাঁরা গণরোষের মুখে পড়বেন— এই হতে হবে পরিস্থিতি। আমাদেরকে নতুন একাত্তর রচনা করতে হবে। এখনই। #
 

প্রাসঙ্গিক তথ্য

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দীক খুন হয়ে যাওয়ার পর নিউজ পোর্টাল ;বাংলা ট্রিবিউন’-এর রাবি-সাংবাদিক সিরাজুচ ছালেকীন আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বাংলা ট্রিবিউনে ছাপার জন্য। হুবহু প্রশ্নোত্তর আকারে “এভরি মার্ডার ইজ এ পলিটিক্যাল মার্ডার” শিরোনামে সিরাজুচ ছালেকীনের প্রণীত সাক্ষাৎকার-অনুলিপি বাংলা ট্রিবিউন আর ছাপেন নি। না ছাপার কারণ আমি জানতে চাই নি। সিরাজুচ ছালেকীনও আমাকে জানান নি। পরে সাংবাদিক দেবদুলাল মুন্নার আগ্রহে সেই অনুলিপির জবাবের অংশগুলোকে অবিকল রেখে সাথে কিছু কথা যোগ করে আমি “আমাদেরকে নতুন একাত্তর রচনা করতে হবে”শিরোনামে স্বতন্ত্র একটি রচনা দাঁড় করাই। সেটি ছাপা হয় তাঁরই সম্পাদিত ‘অপার বাংলা ডট কম’-এ (https://archive.is/T9uS1)। এখন সেই রচনাটিই “সরন-প্রতিসরণ”-এ প্রকাশিত হলো পৃথক শিরোনামে — সরন: ৩০শে মার্চ ২০১৭

উপরের গ্রাফিক ছবি: সেলিম রেজা নিউটন। অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দীকের ছবি অবলম্বনে। ব্যবহৃত সফটওয়ার ইঙ্কস্কেপ, জিএনইউলিনাক্স, ডেবিয়ান।

 
 
 
 
 
Logo