মুখস্থ মানে অলরেডি যেটা মুখে অবস্থিত। যেটা মুখে আনার জন্য মাথা খাটাতে হয় না। চিন্তা করতে হয় না। যা ‘মুখে আবৃত্তিযোগ্য’, যাতে আমরা ‘উত্তমরূপে অভ্যস্ত’ (হরিচরণ, বঙ্গীয় শব্দকোষ)। মুখস্থ অভ্যাস মোতাবেক আমরা যখন ‘ম্যাস কমিউনিকেইশন’ বলি, তখন একটা ভেজাল হয়ে যায়। সেটা হয় ‘ম্যাস’ শব্দটাকে নিয়ে। আমাদের মনে সাধারণভাবে একটা ধারণা কাজ করে যে, ম্যাস কমিউনিকেইশন মানে বোধ হয়, জনসাধারণের যোগাযোগ করার মতো কোনো একটা বিষয়। আসলে ইংরেজিতে ‘ম্যাস’ শব্দটার – আবার বাংলাতেও ‘গণ’ শব্দটার – খানিকটা ভিন্ন রকমের একটা অর্থ আছে কিন্তু। সেটাই আদি অর্থ।
এখন ‘ম্যাস কমিউনিকেইশন’ বা ‘গণযোগাযোগ’ শব্দটা যে আমরা বলি, সেটা নানান ধরনের রাজনৈতিক এবং খেয়াল-না-করা-জনিত কারণে জনসাধারণের যোগাযোগ জাতীয় একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ইংরেজি ‘ম্যাস’ শব্দটার আমরা বাংলা করেছি ‘গণ’। এখানেও শব্দের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে এক দফা বিপর্যয় ঘটেছে। আদি বিপর্যয়। মিডিয়া বা ম্যাস মিডিয়াকে বোঝার ক্ষেত্রে যত বিপত্তি এখান থেকে। ‘ম্যাস’ আসলে একটা দলা। পদার্থের দলা। ম্যাস মানে দলা-পাকানো জিনিস। পুঞ্জ। গাদা। স্তুপ। পালা করা জিনিস। এক জায়গায় গাদা করা জিনিসপত্রের স্তুপ। পুঞ্জীভূত পদার্থ। তো, ‘ম্যাস’ জিনিসটার একটা শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য বা চিহ্নই হচ্ছে যে, এখানে একটা ‘ম্যাস’-এর মধ্যে এক জন থেকে আরেক জনকে আলাদা করা যায় না। এখানকার একটা একটা জিনিসকে আলাদা আলাদা করে শনাক্ত করা যায় না। এক পাল মানুষ মানে ফেসলেস পিপল। এখানে আমি নিউটন আপনি শিবলী, এই পার্থক্য বিচার করা যায় না– যখন আমরা বলি ‘ম্যাস’, যখন আমরা বলি ‘গণ’। বাংলাতেও দেখবেন যে ‘গণ’ মানে: ‘সমূহ, নিচয়, সমুদয়’; ‘যুথ, দল’ (হরিচরণ, বঙ্গীয় শব্দকোষ)। সোজা বাংলায় বললে, পাইকারি হারে গাদি করা জিনিস। গণহারে জমা করা জিনিস। ঢালাওভাবে এক জায়গায় ঢেলে রাখা জিনিস। এখানে নির্দিষ্ট ব্যক্তির বা নির্দিষ্ট পৃথক পৃথক পদার্থের কোনো পরিচয় আমরা শনাক্ত করি না, করতে চাই না, করতে পারি না। ব্যক্তিবিশেষের হিসাব এখানে নাই। মানুষের একটা গাদার সঙ্গে তথা মানুষের একটা পাল, যুথ, বা গোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো একটা একক কেন্দ্র থেকে যখন কেউ যোগাযোগ করে, যেখানে যোগাযোগের উৎস বা সোর্স বা যোগাযোগ-কর্তারা নিজেরা ব্যক্তি হিসেবে ‘অদৃশ্য’ থাকেন, যার নাম পত্রিকা, যার নাম টিভি, যার নাম মিডিয়া, বা এরকম কিছু যেখানে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে আপনি সোর্স হিসেবে শনাক্ত করতে পারেন না; ঐ প্রতিষ্ঠানটাই আসলে যখন একটা মুখোশের মতো করে একটা আড়ালে দাঁড়িয়ে এরকম একটা একপাল লোকের সঙ্গে গণহারে, একসঙ্গে, সবার সঙ্গে, এক সুযোগে, ‘যোগাযোগ’ করার চেষ্টা করে – আসলে বার্তা বর্ষণ করার চেষ্টা করে, একতরফাভাবে – তখন সেটাকে ম্যাস কমিউনিকেইশন’ বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। ধারণাটা এসেছিল ‘ম্যাস সোসাইটি’ থেকে। একটা গাদা-করা সমাজ। পালবদ্ধ সমাজ। এরকম সমাজ গড়ে উঠছিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলুশনের সময়কালে– যখন বড় বড় শহরগুলো গড়ে উঠছে, নিউ ইয়র্কের মতো, যেখানে গোটা আমেরিকার, আমেরিকার বাইরের, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের, নানান গ্রামের, নানান ভাষার, নানান জাতির, নানান ধর্মের, লোকেরা এসে একত্রিত হচ্ছে একটা বড় শহরে। এরকম বড় শহরের শহুরে সমাজে কেউ কাউকে চেনে না। সবার আলাদা আলাদা পরিচয় নাই। আজকের ঢাকা শহরে খানিকটা যেরকম। আপনি কে আমি কে এই শহরে শনাক্ত করা অনেক কঠিন। এরও চাইতে অনেক বেশি রকমের দলা-পাকানো অনেক সমাজ গড়ে উঠছিল গড়ে উঠছিল শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে। নতুন গড়ে উঠতে থাকা বড় বড় নগরগুলোতে। সমাজতাত্ত্বিকেরা ঐসব শহুরে সমাজেরই নাম দিচ্ছিলেন ‘ম্যাস সোসাইটি’ বা ‘গণসমাজ’। বিদ্যায়তনিক বাংলায় এটাই চালু আছে– ‘গণসমাজ’। কিন্তু ‘গণ’ কথাটার উপরোক্ত অর্থটা যদি আমরা মনে রাখি – ‘দলা-পাকানো’ – তাহলে বুঝব এটা দলাপাকানো সমাজ। এটা পুঞ্জীভূত সমাজ – যেখানে আপনি-আমি চ্যাপ্টা হয়ে চিপ্টেলেপ্টে একটা জীবনকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে আছি। তো, ম্যাস সোসাইটি তাহলে একটা ফেসলেস সোসাইটি। এখানে ব্যক্তির চেহারা নাই। এটা একটা রুটলেস সোসাইটি। একদা আপনি যে গ্রামে ছিলেন, আপনার সারাজীবনের স্মৃতি ছিল, গান ছিল, পরিচয় ছিল, ধর্ম ছিল, নিজস্ব নানান বৈশিষ্ট্য ছিল, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক বৈশিষ্ট্য, গ্রামে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের বোঝাপড়া জানাশোনা ছিল– সেগুলো এখানে নাই। এখানে সবাই উন্মূল। শেকড়হীন মানুষের বিচূর্ণ সমাজ। দলাপাকানো একটা সমাজ। নামহীন, গোত্রহীন, চেহারাহীন, পরিচয়হীন একটা সমাজ। ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যহীন একটা সমাজ। ‘ম্যাস সোসাইটি’র এই আলাপে ‘ম্যাস’ কথাটার যে অর্থ তুলে ধরা হলো, সেই অর্থে ‘ম্যাস কমিউনিকেইশন’ কথাটাকে না-বোঝাতেই হয়েছে যত গ্যাঞ্জাম। আরেকটু ভেঙে তাহলে যদি বলি, ‘ম্যাস কমিউনিকেইশন’-এর মূল ব্যাপারটা আসলে কী? এটা আসলে এক ধরনের পাইকারি যোগাযোগ। নির্দিষ্ট কারো সাথে নির্দিষ্ট অপর কারো যোগাযোগ নয়। ঢালাও যোগাযোগ। ‘গণযোগাযোগ’ কথাটাও এই অর্থেই। গণযোগাযোগ মানে জনসাধারণের যোগাযোগ নয়। জনসাধারণের নিজস্ব যোগাযোগ-প্রণালী নয়। প্রচুর সংখ্যক বা বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিমানুষের সাথে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মানবীয় যোগাযোগ নয়। মানুষে-মানুষে যোগাযোগ নয়। অমানবীয় যোগাযোগ। অজৈব যোগাযোগ। ইন-অর্গানিক যোগাযোগ। কোটি টাকার যন্ত্রের পক্ষ থেকে আপামর মানুষের সাথে যোগাযোগ। যান্ত্রিক যোগাযোগ। মেশিনের যোগাযোগ। মেশিন ছাড়া ‘ম্যাস কমিউনিকেইশন’ নাই। আমি কিন্তু যন্ত্র মাত্রেরই নিন্দামন্দ করছি না। মেশিন বলতে এখানে গোটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল যোগাযোগের বা মিডিয়া-প্রতিষ্ঠানের সার্বিক আমলাতন্ত্রকে বোঝাচ্ছি। আমলাতন্ত্র জিনিসটাই তো আসলে একটা মেশিন। অনেক কাল আগে জার্মানির এক তাত্ত্বিক হুডল্ফ হকার বলেছিলেন যে, আমলাতন্ত্র একটা প্রাণহীন, যান্ত্রিক একটা মেশিন (হুডল্ফ হকার: ‘নৈরাজ্যবাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য’, অ্যানার্কিজম অ্যান্ড অ্যানার্কো-সিন্ডিক্যালিজম)। আমাদের মহাত্মা গান্ধী খুব পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলেছিলেন – এ ধরনের আমলাতন্ত্রের আরও বৃহৎ একটা রূপ রাষ্ট্র – গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রই একটা ‘আত্মাহীন মেশিন’– ‘দ্য স্টেট ইজ এ সোললেস মেশিন’। ‘ব্যক্তির আত্মা থাকে, রাষ্ট্রের আত্মা থাকে না’। কারণ রাষ্ট্র মেশিন। আমলাতন্ত্র মাত্রেই তাই। (দ্রষ্টব্য: নির্মল কুমার বসুর নেওয়া মহাত্মা গান্ধীর সাক্ষাৎকার। ১৯৯৯ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ৯৮ খণ্ডে প্রকাশিত দ্য কালেক্টেড ওয়ার্কস অফ মহাত্মা গান্ধী নামের ই-বইয়ের ৬৫তম খণ্ডের ৩১৬-৩২০ পৃষ্ঠা।) এখানে মেশিনের যোগাযোগ মানে ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগ। মিডিয়া-ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগ। কমিউনিকেইশন-ইন্ডাস্ট্রির যোগাযোগ। আসলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল যোগাযোগ। ইন্ডাস্ট্রিতে উৎপাদিত যোগাযোগ। মেশিনে উৎপাদিত যোগাযোগ। এটা একপেশে বার্তাপ্রবাহ। গাজায় ইসরায়েল রাষ্ট্রের একতরফা বোমাবর্ষণের মতো। কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের নিরন্তর একতরফা বার্তাবর্ষণের মতো। এখানে লেনদেন নাই। শেয়ারিং নাই। স্বাভাবিক মনুষ্য-সংস্কৃতি নাই। মনুষ্য-কালচার নাই। আছে ‘ম্যাস কালচার’। ‘ম্যাস সোসাইটি’র কালচার। ‘ম্যাস কালচার’ মানেই মেশিনের কালচার। ইন্ডাস্ট্রির কালচার। ঢালাও কালচার। দলাপাকানো কালচার। যেমন গানের ইন্ডাস্ট্রি– সেখান থেকে গণহারে, পাইকারি হারে গান উৎপাদনের মতো। লেবেল লাগানো আলাদা আলাদা গান নিরন্তর উৎপাদিত হচ্ছে। ফোক-গান, ক্লাসিকাল গান, রক গান, পপ গান, জ্যাজ – নানান ক্যাটেগরির গান। আপনি রেডিমেড চাইবেন এবং পাইবেন। ‘ম্যাস কালচার’ সেরকম। একটা বিমান থেকে কয়েক লক্ষ প্রচারপত্র ছড়ানো হলো। যে পেল– পেল, যে পেল না– পেল না। একটা মাইক থেকে চিৎকার করা হতে থাকল। যার কানে গেল– গেল, যার কানে গেল না – গেল না। এই হচ্ছে ‘ম্যাস কালচার’। এই হচ্ছে ‘গণযোগাযোগ’। ‘ম্যাস কমিউনিকেইশন’ জিনিসটার উৎপত্তিই হয়েছে ‘ম্যাস সোসাইটি’র শাসকদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। ঐ যে ‘ম্যাস সোসাইটি’র কথা বলছিলাম নিউ ইয়র্কের শহুরে সমাজের মতো, সেই ধরনের সমাজে এই যে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত, বিচিত্র জায়গা থেকে, ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা মানুষরা – এই ধরনের মানুষদেরকে নিয়ে গড়ে ওঠা একটা দলাপাকানো সমাজকে আপনি কেমন করে শাসন করবেন? কেমন করে নিয়ন্ত্রণ করবেন? কেমন করে ওদেরকে একটা নির্দিষ্ট ধারায়, নির্দিষ্ট ধাঁচে, ‘ভদ্র’-‘শহুরে’-‘সুশীল’ চিন্তাকাঠামোতে গড়ে তুলবেন? এই প্রয়োজন থেকেই – শাসকশ্রেণীর এই প্রয়োজন থেকেই – এই ‘ম্যাস কমিউনিকেইশন’-এর উৎপত্তি। এখন, এইভাবে যদি ‘ম্যাস কমিউনিকেইশন’কে দেখি, তাহলে হিউম্যান কমিউনিকেইশন কী? মানবীয় যোগাযোগ কী বস্তু? সত্যিকারের মানবীয় যোগাযোগ মানে কিন্তু গণযোগাযোগ নয়। মানবীয় যোগাযোগ মানেই আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ, ইন্টারপার্সোনাল কমিউনিকেইশন, ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে যোগাযোগ। বাংলায় দেখবেন, যোগাযোগ শব্দটার মানেই হলো যোগ এবং যোগ। যোগ প্লাস যোগ (যোগ + যোগ)। ‘পরস্পরের যোগ বা সমাগম’ (হরিচরণ, বঙ্গীয় শব্দকোষ)। পরস্পরের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা। পরস্পরের সাথে যুক্ত হওয়া। আমরা যারা কমিউনিকেইশন পড়ি-পড়াই, এ ধরনের চাকরিবাকরির সাথে যুক্ত, আমরা তিনটা গণহারে ভাগ করি যোগাযোগকে। একটা হচ্ছে: মানুষ নিজেই নিজের মধ্যে চিন্তা করতে করতে কেমন করে জানি নিজেই নিজের সাথে যোগাযোগ করে। এটার নাম ইন্ট্রাপারসোনাল কমিউনিকেইশন। অন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ। ব্যক্তির ভেতরে-ভেতরে, মানে নিজে-নিজে যোগাযোগ। দ্বিতীয়টা হচ্ছে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ। আপনার সঙ্গে আমার। ইন্টারপার্সোনাল কমিউনিকেইশন। আরেকটাকে বলে ম্যাস কমিউনিকেইশন। ছোটবেলায় যখন তোতাপাখির শিক্ষাপ্রণালীর মতো করে এগুলো আমাদেরকে পড়তে হয়েছিল ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখনই খেয়াল করেছিলাম, কমিউনিকেইশন মানেই আসলে ইন্টারপার্সোনাল কমিউনিকেইশন। (এ নিয়ে গোপনে ইংরেজি ভাষায় একটা প্রবন্ধও লিখে ফেলেছিলাম, কোথাও ছাপতে দেওয়ার বা মুখে কাউকে বলার বা পরীক্ষার খাতায় লেখার সাহস তখন হয় নি, কেননা ওগুলো লেখার নিয়ম নাই, আপনি যা লেকচার শুনবেন সেটাই তো লিখবেন, নিজে নিজে চিন্তা করতে শুরু করবেন না, তা ছাড়া তো ফার্স্টক্লাস পাবেন না, ফেলও করতে পারেন, বেয়াদবির সমতূল্য হবে সেগুলো)। সত্যিই, মানবীয় যোগাযোগ মানেই আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ। এমনকি যখন আমরা নিজেরা নিজের মধ্যে চিন্তা করি, নিজের সাথে নিজে এক ধরনের যোগাযোগ করি, সেখানেও কিন্তু আমি ভিন্ন একটা মানুষ-সত্তা হিসাবে (নিখিল মনুষ্য-সত্তার সুনির্দিষ্ট রূপ হিসেবে) ‘আমি’ নামে পরিচিত মানুষ-সত্তার সাথে যোগাযোগ করি, কথা বলি, সেটা মূলত একটা ইন্টারপার্সোনাল রূপই নেয়। এমনকি যেটাকে গণযোগাযোগ বলি, সেখানেও আদতে এই ইন্টারপার্সোনাল কমিউনিকেইশনই ঘটে। ঐ যে আপনি বিমান থেকে দিলেন কয়েক লক্ষ প্রচারপত্র ছেড়ে, কিংবা টেলিভিশনের একটা অ্যাড ২৪ ঘণ্টা বাজাতে থাকলেন, কয়েক কোটি লোকের চোখে-মুখে-কানে-মাথায় অহরহ বর্ষিত হতে থাকল, যে-বোমাবর্ষণের হাত থেকে আমাদের এক মুহূর্তের নিষ্কৃতি নাই, আপনার মায়ের পেটে থাকা থেকে শুরু করে মৃত্যুবরণ করার পরে পর্যন্ত (মুনকার-নাকির এসে হাজির হওয়ার আগে পর্যন্ত কিনা কে জানে), আপনাকে-আমাকে সার্বক্ষণিকভাবে এই ম্যাস কমিউনিকেইশন মেসেজের বম্বিঙের মধ্যে থাকতে হয়, সেই ম্যাস কমিউনিকেইশনের মধ্যেও দেখবেন ঐ বোমাটা যখন গিয়ে পড়ে, বোমাটা কী জিনিস তাই নিয়ে যে-দুজনের কাছে বোমাটা পড়েছে, বা যে একজনের কাছে পড়েছে, সে বা তারা আরেক জনের সাথে কথা বলে। যতক্ষণ না সে আরেক জনের সাথে কথা বলে, যতক্ষণ না সে মনে মনে আরেকটা মানুষ হয়ে ঐ বোমাটাকে বোঝার, বোঝাপড়া করার – যেকোনোভাবেই হোক – চেষ্টা করে, চিন্তা করে, ততক্ষণ পর্যন্ত ম্যাস কমিউনিকেইশন কোনো রকমেরই যোগাযোগের সার্থক জায়গা পর্যন্ত পৌঁছায় না। এটা একতরফা এখান থেকে মারা একটা ঢিল ওখানে গিয়ে পড়ে থাকার সমতুল্য হয়। একটা ঢিল গিয়ে মাঠের মধ্যে পড়ে থাকবে – তার জন্য কেউ কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন বানায় না বা পত্রিকা চালায় না। আমরা ঐ ঢিলটাকে নিয়ে পরস্পরের সাথে কথাবার্তা বলি। যোগাযোগ করি। তখনই জিনিসটা আদৌ একটা যোগাযোগ ধরনের চেহারা ধারণ করে। বিজ্ঞাপন নিয়ে কেউ যদি পরস্পরের সাথে কোনোপ্রকার কথাবার্তা না বলত, যাবতীয় বিজ্ঞাপন ব্যর্থ হতো। তার মানে, যোগাযোগ মানেই ঐ ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে যোগাযোগ। আর, গণযোগাযোগ মানে গ্যাঞ্জাম– দলাপাকানো সমাজের মাথায় শাসক-কোটিপতিদের ছুঁড়ে মারা যোগাযোগের আবর্জনার দলা। দলাটাকে আমরাই মাথায় করে রাখি। আবর্জনার ভেতরে এনকোড-করে-দেওয়া নিয়ম-কানুন-যুক্তি-সূত্র ধরে ধরে পরিষ্কার একটা জায়গা খুঁজি– আবর্জনার সীমার ভেতরেই চিন্তা করি। পরিণামে আমরা আমাদেরকে সমাজটাকে আর চিনতে পারি না, বুঝতে পারি না, বোঝাতে পারি না, বদলাতে পারি না। মুখস্থ কথাবার্তার মুখস্থ অর্থের ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকি। রাবি: ৯ই মে ২০১৫