English | বাংলা
Logo
 

 

গুমনদীর পারে

কাব্যগ্রন্থ: অমার মতো ট্রমার মতো, ০১-১২-২০১৭

 

 

 

গুমনদীর পারে

 

কবিতাটাকে জীবনানন্দের দিকে

টার্ন করাতে পারছি না কিছুতেই

কি যে ভয়াবহ মুশকিলে পড়েছি!

এতটাই ভয়ের আবহ যে, কবিতাটবিতারও আগে
যদি একটু দোয়াদরুদ পড়ে নেওয়া যেত! কিন্তু গুমের ব্যাপারে

মুখ খোলা তো দূরের কথা, কোনো দোয়া পর্যন্ত

খুঁজতে রাজি হচ্ছে না আম্মা।
 

খুঁজলে কি পাওয়া যেত? গুমের আয়াত?
আল্লার নাম নিয়ে জীবন ও মৃত্যুর প্রশ্নে নির্ভয়ে মগ্ন হওয়া যেত।

 

গুম একটা পাঁচকোনা গায়েবি রোবট
কোনো ধর্মগ্রন্থে যার উল্লেখ নাই
যার পেটের নিচে পাঁচটা কোরে চাকা থাকে
এবং যা অপেক্ষা করে রাস্তার ধারে অদৃশ্য আদলে।
দিনশেষে বাড়ি ফেরার গাড়ি পেতে কারো বেশি কষ্ট হলে-টলে
রোবট তাকে বিশ্রাম দিতে চায়।

আজাজিলের আবৃত্তির স্বরে

বহুরুপী রোবটটা কোথা থেকে এসে
ক্লান্ত, অপেক্ষারত টার্গেটকে ঠেসে ধরে বলে:
‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল
অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে পথিকের চৌদ্দ গোষ্ঠী তিল তিল করে

আস্তে আস্তে ... ধীরে ...।

 

ইতোমধ্যে এ কয় বছরে

পাঁচ শ উনিশ বার গুম করা হয়েছে মানুষকে।

কেউ কেউ ফিরে আসে, তাদের জবান

বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে অ্যাট লিস্ট গুমের ব্যাপারে;

লাশ পাওয়া যায় কারো; বাকিরা যে হারায় কোথায়!

স্বাভাবিক মৃত্যু বলে আর কিছুই থাকবে না বোধ হয়

অথচ গুম নিয়ে আমার উদ্বেগ

ভালো চোখে দেখতেসে না আম্মা।
আম্মাও কি ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রী হতে চাচ্ছে, মাবুদ?

 

মুক্তির আর স্বাধীনতার যুদ্ধে খুন হওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাধীন রাষ্ট্রে

‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ সেই স্লোগান

সেটা ছিল নির্মল সেনদের রাজনীতির কি সুন্দর, স্বাধীন এক চাওয়া।

তখনও মৃত্যু কি যে সুন্দর ছিল গোলাপের লোবানের গন্ধ মাখানো

কাফনের শুভ্রতায় চিতার লকলকে কম্পমান আগুনের শিখায়

রঙিন লাউডগার মতোন শুদ্ধতম বিশুদ্ধতায়।

কাঁঠালের পাতা ঝরে যাওয়ার মতোন করে সকলেরই মৃত্যু হতো;

াছরাঙাটির সাথী মরে গেলেদুপুরের নিঃসঙ্গ বাতাসে

তবু ওই পাখিটির নীল লাল কমলা রঙের ডানা স্ফুট হয়ে ভাসত আভাসে

ত্যি কি মুক্তিযুদ্ধ ফিরে আসবে? যদি ফিরে আসে!

 

এখন জীবনের সব আনন্দ চুরি করে অন্ধকারে দাঁড়ায়

ক্ষুধা নয়, দুর্ভিক্ষ নয়, যুদ্ধ নয়, এমনকি মৃত্যুও নয়

মৃত্যুহীনতার মতোন এক বোধ,

চকচকে নতুন এক বিপন্ন বিস্ময়।

 

জীবনের হাত থেকে কোথাও মুক্তি নাই, মৃত্যু যেন কোথাও নাই আর

বিভ্রম আছে খোদ মৃত্যু গুম হয়ে যাওয়ার!

মৃত্যুকে খুব বেশি কাঙ্ক্ষিত রঙে আজ তুলেছে রাঙিয়ে

মিডিয়ায় উধাও হওয়া মৃত্যুহীনতার বোধ এসে

মরার খবরটুকু নিশ্চয়তা সহকারে পাবে বলে ভীষণ অপেক্ষায়

মরীচিকার মাঝখানে পিতা আর সন্তান মোবাইল হাতে বসে আছে।

যদি আসে!

আদরমাখানো মুখের ভ্রান্তিটুকুনও যদি হঠাৎ ফিরে আসে!

শেষবারের মতো শুধু মরামুখ এক ঝলক দেখার প্রয়াসে

বাচ্চা-ধারণ-করা মাতৃগর্ভ, ভূ-গর্ভ হাঁ করে রয়েছে আশায়

মানুষটা না ফিরুক ন্তত মৃতদেহ ফিরে তো আসুক।

 

ৃত্যুকে ফেরত চাই, মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই ও আমার দেশের মাটি!

গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে, থ্যাঁতা হয়ে দ্রুতগামী যানবাহনের চাকায়,

নিরাপদ হেফাজতে আটকাবস্থায় হার্টফেল করে,

জেলখানায় বিনাচিকিৎসায়, ত্মহত্যায়, এমনকি ক্রসফায়ারে

স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিক যেকোনো উপায়ে

আমরা মরতে চাই গুম হতে চাই না, জননী!

স্রেফ কাপড়কাচার পচাসাবানে হলেও আমরা ধোয়াতে চাই

প্রিয়জনের লাশ

তাকে নিয়ে যেতে চাই শ্মশানে, গোরস্থানে, গ্রেভইয়ার্ডে

পরম করুণাময়ের নামে। নির্দিষ্ট তারিখ চাই নির্দিষ্ট মৃত্যুর

ছর ঘুরলে যেন আমরা কাঁদতে পারি মসজিদে, দেবালয়ে, শহিদমিনারে।

জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলুক যারা খেলার

কিন্তুু নিশ্চয়তা সহকারে

মরার অধিকার নিয়ে গোলমাল হলে

সম্পূর্ণ সিস্টেমটাই গোল খেয়ে যেতে পারেপ্লিজ!

 

সমুদ্রের তলদেশে লুকিয়ে রাখা জেলখানার হাওয়া

ভেসে ওঠে আঁধার-কালো সবুজের মতোন শৈবালের বুদ্বুদে

নীল লাল কমলা রঙের মাছের ঊর্ধ্বগামী নিঃশ্বাসে;

চিরেই চিলের পাখনায়

সে বাতাস রাষ্ট্র হয়ে যায়

অপরাজিতার মতো নীল হয়ে আরো নীল আকাশে আকাশে।

বং মি এমন কোনো সম্রাট অথবা সম্রাজ্ঞীর নাম শুনি নি

যে নাকি আকাশকে মানুষের চোখ থেকে গুম করতে পারে।

জমাট মেঘ থেকে জলকণাকে হাওয়া করে দেওয়ার মতো

পাঁচকোনা অথবা এগারোকোনা গুমযন্ত্র আবিষ্কৃত হয় নি এখনও।

 

অথচ পুরো পৃথিবীকে এখন আমার

গুমের নদীর পারে গায়েবের দেশ বলে ভ্রম হচ্ছে, হে বুদ্ধদেব বসু!

এবং এই কবিতাটাকে কিছুতেই আমি

নিয়ে যেতে পারছি না মায়াবীর নদীর পারের কোনো দেশে

শঙ্খচিল শালিখের বেশে। শুধু মনে হচ্ছে ট্রামের চাকাও

অনেক বেশি সদয়, সুন্দর!

ার নিচে পড়ে গেলে মানুষের মৃত্যু আসে

ুম হয় না সে।

 

গুম এমন একটা শক্তিশালী মেশিন, মৃত্যুর মুখোমুখি যা দাঁড়াতে পারে না,

েমন রিম্যান্ডে নেওয়া মানুষের বাঁধা হয় চোখ

কেননা স্বয়ং অত্যাচারের চোখে চোখ রাখতে পারে না অত্যাচারও

ে হায় আয়না জুড়ে অন্ধকার দেখতে ভালোবাসে।

যে চোখের সৎকার হয় নি তার দৃষ্টি ফিরে আসে

ে হাসে বাতাসে, তার কান্না হাসে প্রাসাদের কোনায় কোনায়;

যে মানুষ গুম হয়ে যায়

তার কন্যা — আরিয়ানা চিরকাল থাকে অপেক্ষায়

প্রেতদৃষ্টি খুব খারাপ, বাইরে চলে যেতে পারে, গুমযন্ত্রের য়ত্তের বাইরে

মৃত্যুর সাথে জীবনের পার্থক্যকে গুম করা যায় না কিছুতেই।

 
 
 
 
 
Logo