English | বাংলা
Logo
 

 

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এবং ক্রিপ্টো অ্যানার্কির যোগাযোগ

দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৭-০৫-২০১৫

Somerset Bean: http://somersetbean.blogspot.com/2012_06_01_archive.html

গণযোগাযোগ মানে জনসাধারণের যোগাযোগ নয়। জনসাধারণের নিজস্ব যোগাযোগ-প্রণালী নয়। প্রচুর সংখ্যক বা বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিমানুষের সাথে ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মানবীয় যোগাযোগ নয়। মানুষে-মানুষে যোগাযোগ নয়। অমানবীয় যোগাযোগ। অজৈব যোগাযোগ। ইন-অর্গানিক যোগাযোগ। কোটি টাকার যন্ত্রের পক্ষ থেকে আপামর মানুষের সাথে যোগাযোগ। যান্ত্রিক যোগাযোগ। মেশিনের যোগাযোগ।মেশিন ছাড়া ‘ম্যাস কমিউনিকেইশন’ নাই।

আমি কিন্তু যন্ত্র মাত্রেরই নিন্দামন্দ করছি না। মেশিন বলতে এখানে গোটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল গণযোগাযোগের বা মিডিয়া-প্রতিষ্ঠানের সার্বিক আমলাতন্ত্রকে বোঝাচ্ছি। আমলাতন্ত্র জিনিসটাই তো আসলে একটা মেশিন। অনেক কাল আগে জার্মানির এক তাত্ত্বিক হুডল্ফ হকার বলেছিলেন যে, আমলাতন্ত্র একটা প্রাণহীন, যান্ত্রিক একটা মেশিন। আমাদের মহাত্মা গান্ধী খুব পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলেছিলেন – এ ধরনের আমলাতন্ত্রের আরও বৃহৎ একটা রূপ রাষ্ট্র – গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রই একটা ‘আত্মাহীন মেশিন’– ‘দ্য স্টেট ইজ এ সোললেস মেশিন’। ‘ব্যক্তির আত্মা থাকে, রাষ্ট্রের আত্মা থাকে না’। কারণ রাষ্ট্র মেশিন। আমলাতন্ত্র মাত্রেই তাই।

‘গণযোগাযোগের গ্যাঞ্জাম’, আলোকিত বাংলাদেশ, ১১ই মে ২০১৫

উপরোক্ত লেখাটিতে গণযোগাযোগের স্বভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে মানবীয়তার বিপরীতে মেশিনের সাথে গণযোগাযোগের যুক্ততা নিয়ে বলতে হয়েছিল। মেশিন বলতে সেখানে আমি প্রাণহীন, যান্ত্রিক, বৃহৎ পুঁজির কর্তৃত্বতন্ত্রওয়ালা একটা সামগ্রিক মেশিনারি ওরফে মেকানিজমের কথা বুঝিয়েছিলাম। উদ্ধৃতিটুকু খেয়াল করলে দেখা যাবে, যন্ত্র বা মেশিন মাত্রেরই বিরোধিতা আমি করি নি। মানুষে-মানুষে যোগাযোগের ক্ষেত্রে মেশিনের ব্যবহার খারাপ বা আপত্তিকর কিছু সেরকম ইঙ্গিতও আমি করি নি। আমি বলতে চেয়েছি, যন্ত্র যখন এরকম একটা কর্তৃপক্ষীয় আমলাতন্ত্রের চাকুরিজীবী চাকর বা গোলামদের হাতে পড়ে নিজেও গণবিরোধী এলিট-কর্তৃপক্ষের গোলাম হিসেবে কাজ করে তখন তা আর মানবীয় যোগাযোগ থাকে না, তথাকথিত গণযোগাযোগে পরিণত হয়। পরিণত হয় হিজ মাস্টার্স ভয়েসে। সেটি তখন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-মিডিয়ানৈতিক কর্তৃপক্ষের ইলেকট্রনিক চোঙা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর একপেশে বোমাবর্ষণের মতো একপেশে ও সর্বগ্রাসী ‘তথ্য-বিনোদন’-বর্ষণের প্রতি আমরা মুখস্থ অভ্যাসে কান পেতে রাখি এবং ঐ চোঙার কথায় জীবনসমর্পণ করে ঠুলিপরানো বদ্ধদৃষ্টি মানুষের মতো ঘুরপাক খাই যাপনে-মননে-আচরণে।
 

আসলে, মানবীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে মেশিনের ভূমিকা একেবারে অন্যরকমও হতে পারে। সেটা নির্ভর করে ব্যক্তি ও সমাজ কতটা স্বাধীনতাশীল, আত্মমর্যাদাবান এবং আত্মনিয়ন্ত্রণপ্রবণ তার ওপরে। এই ধরনের মানুষেরা বিদ্যমান কর্তৃত্বতান্ত্রিক ভাগাড়ের মধ্যে বসবাস করেই, এরই ভেতরে, নতুন সমাজ বানানো শুরু করেন। ‘সাইফারপাঙ্কস’ তথা ‘ক্রিপ্টো অ্যানার্কি’র (‘সাইফারপাঙ্কস’ তথা ‘ক্রিপ্টো অ্যানার্কি’র) যোগাযোগ এইরকমের প্রকৃত মানবীয় ধারার যোগাযোগ যেখানে মেশিন পালন করে ইতিবাচক ভূমিকা ( ‘সাইফারপাঙ্কস’ তথা ‘ক্রিপ্টো অ্যানার্কি’ সম্পর্কে দ্রষ্টব্য: টিম মে, ‘দ্য ক্রিপ্টো অ্যানার্কিস্ট শ্যানিফেস্টো’, ১৯৮৮; জন পেরি বার্লো, ‘এ ডিক্লারেশন অফ ইনডিপেন্ডেন্স অফ সাইবারস্পেস’, ১৯৯৬; পিটার লাডলো, ‘ক্রিপ্টো অ্যানার্কি, সাইবারস্টেটস, অ্যান্ড পাইরেট ইউটোপিয়া’, ২০০১; জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, ২০১২; সেলিম রেজা নিউটন, ‘সাম্রাজ্য স্বাধীনতা ইন্টারনেট’, ২০১৪।)।
 

নতুন সমাজ আমূল পরিবর্তিত নতুন ধরনের রাষ্ট্র আপনি বানাবেন কেমন করে? রাষ্ট্র কি চেয়ারটেবিল যে সেগুলো ভেঙে ফেলে আপনি নতুন চেয়ারটেবিল বানাবেন? রাষ্ট্র আসলে এটা সম্পর্ক। এক বিশেষ ধরনের রাষ্ট্রীয় সম্পর্কপ্রণালী। রাষ্ট্র আসলে এক বিশেষ ধরনের কন্ডিশন বা শর্ত-পরিস্থিতি। সেই অর্থে রাষ্ট্র তো আসলে আমরাই। আমরাই রাষ্ট্র। আমরাই তো রাষ্ট্রীয় সম্পর্কপ্রণালীতে, রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধসাপেক্ষে জীবনযাপন করি, যোগাযোগ করি, আর্থিক লেনদেন করি। কাজেই রাষ্ট্রকে যদি বদলাতে তাহলে আমাদেরকে নতুন ধরনের সমাজ-সম্প্রদায়-সম্পর্কের অনুশীলন শুরু করতে হবে। এবং সেটা এখনই। এই সমাজের ভেতরে থেকেই। এই হচ্ছে জার্মান অরাজপথু গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়া’র চিন্তাধারা (গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়া, ১৯১০: ২১৪; সেলিম রেজা নিউটন, ২০১৩: ১৫৯)। এই লোকের এই আলাপটুকু হুবহু তুলে দিয়ে রেখেছিলেন ২০০০-২০০৭ সালে লেখা নিজের ব্লগে আজকের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ (জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ব্লগ: আইকিউ ডট ওআরজি)। একটা মজার দিক খেয়াল করার আছে। দিকটা অ্যানার্কির প্রতি আগ্রহী মানুষজনের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমার ধারণা। ‘দ্য ফার্স্ট সার্কেল’ এবং ‘গুলাগ আর্কিপিলাগো’র মতো সাহিত্যের রচয়িতা, বলশেভিক রুশ সাম্রাজ্যের সংগুপ্ত শ্রমকারাগারে অনেক বছর বন্দি শ্রমদাসের জীবনযাপন করেছেন, আলেকজান্ডার সলঝনিৎসিন এবং আরও অনেক বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সমাজচিন্তকের পাশাপাশি এই গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়া ছিলেন অ্যাসাঞ্জের অন্যতম অগ্রসূরী।
 

এখন গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়া হচ্ছেন প্রুঁধো, বাকুনিন, ক্রপোৎকিন, ম্যালাতেস্তাদের মতোই বাম-সমাজতান্ত্রিক নৈরাজ্য-ধারার মানুষ। অন্যদিকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গোটা চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছে পুঁজিবাদী বাজার-নৈরাজ্যের ধারায়। এই ধারা চায়: সরকারী-সামরিক-কর্পোরেট পুঁজি ও কর্তৃত্বতন্ত্রবিহীন ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজির এবং সত্যিকার অবাধ ও স্বেচ্ছাভিত্তিক বিনিময়-লেনেদেনের সনাতন মানবীয় সংস্থা হিসেবে স্বাধীন বাজারকেন্দ্রিক স্বাধীন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর সমাজ। অ্যানার্কো-ক্যাপিটালিজম নামে পরিচিত এই ধারার ‘ক্রিপ্টো অ্যানার্কি’র নামের বিশেষ উপধারাটি যাবতীয় মানবীয় যোগাযোগে ও আর্থিক ইত্যাদি যাবতীয় লেনদেনে ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়ারে পরিচালিত কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়। সফটওয়ার বা কোড-কে ইন্টারনেট-কম্পিউটারভিত্তিক হাইটেক সমাজের ‘আইন’ হিসেবে বিবেচনা করেন। তাঁরা বলেন, ‘কোড ইজ ল’। সুতরাং এরকম একটা বলপ্রয়োগহীন স্বাধীন মানুষের সমাজে আইনী-কর্তৃপক্ষ বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বা বন্দুকধারী কেন্দ্রীয় কোনো শাসনতান্ত্রিক বাহিনীর প্রয়োজন পড়বে না। কোড বলতে এখানে হরেদরে যেকোনো সফটওয়ারকে বোঝাচ্ছে না। ক্রিপ্টোগ্রাফিক কোড-কে বোঝানে হচ্ছে। এই ধারার কোডগুলো যত নিশ্ছিদ্রভাবে ব্যক্তির অ্যানোনিমিটিভিত্তিক (পাবলিক পরিসরে নিজের পরিচয় প্রকাশের বা অপ্রকাশের এবং ইচ্ছামাফিক নির্ধারণের কম্পিউটার-ব্যবস্থা) এবং প্রাইভেসিভিত্তিক সর্বজনীন যোগাযোগ-ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করতে পারবে এবং যত বেশি লোক সেগুলো ব্যবহার করতে শুরু করবে তত বেশি করে মানুষে-মানুষে যোগাযোগের মাঝখানে অন্য কোনো গুরু-গোঁসাই-হুজুর-কর্তৃপক্ষ কোনো ভূমিকা পালনের (এমনকি নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার) মতো পরিস্থিতি পাবে না। কেউ তাদের দ্বারস্থ হবে না। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সমাজ নিজেদের প্রয়োজন নিজেরাই মেটাতে শুরু করবে। কাউকে আইন ভাঙার দায়ে অভিযুক্ত করার সুযোগই থাকবে না। কেননা সেলফোন-ইন্টারনেটভিত্তিক এই ব্যবস্থায় কে কার সাথে কী নিয়ে যোগাযোগ করছেন তার সামান্যতম ইশারাও অন্য কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ জানতে পারবে না। কোনোভাবেই না। মানুষে-মানুষে অর্থনৈতিক লেনদেনও হবে অপ্রকাশে, প্রাইভেট বা ব্যক্তি-ব্যক্তি পর্যায়ে এবং অ্যানোনিমিটি বা অপরিচয়ের আড়ালে। ফলে কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর থাকবে না। কেউ তার দ্বারস্থ হবে না। কেউ আর খাজনা দেওয়ার দরকার মনে করবে না। সরকারী আমলাতন্ত্রের লোকেরাও এইসব যন্ত্রপাতি সফটওয়ার ব্যবহার করবে নিজেদের প্রাইভেসি ও যোগাযোগ-নিরাপত্তার স্বার্থে। ফলে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ তার ওপর যোগাযোগগত নিয়ন্ত্রণ বজার রাখতে পারবে না। এই ধরনে যন্ত্র-প্রযুক্তি-অ্যাপ ইতোমধ্যে বাজার সয়লাব করে ছড়িয়ে পড়ছে। এ জিনিস ঠেকানোর কোনো উপায় আর কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষের থাকবে না। এই অর্থে ‘কোড ইজ ল’।
 

বোঝাই যাচ্ছে এরকম একটা সমাজ বর্তমান সেনাকর্পোরেট রাষ্ট্রপ্রণালী কর্তৃক পরিচালিত সমাজের – অর্থাৎ পুরনো সমাজের ভেতরেই – গড়ে উঠতে শুরু করতে পারবে এবং শুরু করেছে ২০-২৫ বছর ধরে। ইতোমধ্যেই বাজারে রীতিমতো বাধাবিপত্তিহীনভাবে, সম্পূর্ণ নিরাপদে, পরিপূর্ণ প্রাইভেসি ও অ্যানোনিমিটি সহকারে, সফলভাবে, অপ্রতিরোধ্যভাবে চলছে ‘বিটকয়েন’ নামের ক্রিপ্টো-মুদ্রা। এটা একটা স্বপরিচালিত সফটওয়ার মাত্র। এর কোডের বাইরে আপনি চাইলেও ভিন্নভাবে লেনদেন করতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষের বানানো ও বন্দুকহাতে তত্ত্বাবধান করা আর্থিক আইনকানুনের প্রয়োজন এখানে পড়ছে না। কোডই এখানে সামাজিক-আর্থিক আইন। এই অর্থে ‘কোড ইজ ল’। হু হু করে বাড়ছে এর ব্যবহার। আপনার টাকার এত বেশি নিরাপত্তা আর কেউ কোনোদিন দিতে পারে নি। সুতরাং আপনিও অচিরেই এই মুদ্রা ব্যবহার করতে শুরু করবেন সন্দেহ নাই। অ্যানোনিমিটি ও প্রাইভেসির মাত্রা এখানে এমনই উঁচু মাত্রার যে এই ধরনের সফটওয়ার ব্যবহার করাটাকে লাভজনক মনে করতে শুরু করবে বেশিরভাগ মানুষ।
 

এই ধরনের যন্ত্র-প্রযুক্তি-অ্যাপ অলরেডি বাজার সয়লাব করে ছড়িয়ে পড়ছে। বাজারে চলছে ‘সাইলেন্ট ফোন’, ‘সাইলেন্ট টেক্সট’, ‘রেড ফোন :: প্রাইভেট কল’, ‘টেক্সট সিকিউর :: প্রাইভেট মেসেঞ্জার’ এবং সর্বোপরি ‘উইকিলিকস’ এর মতো অজস্র সফটওয়ার। [ আপডেট: রেডফোন এবং টেক্সট সিকিউর অ্যাপ দুটো একত্র হয়ে এখন "সিগন্যাল" নামে জনপ্রিয় একটি অ্যাপে পরিণত হয়েছে। এটি অ্যান্ড্রয়েড এবং আইফোন উভয় প্ল্যাটফর্মে কাজ করে। এটি বার্তা আদানপ্রদান এবং অডিও/ভিডিও উপায়ে কথা বলার সর্বোচ্চ মাত্রায় এনক্রিপ্টেড একটি অ্যাপ। – সরন: ২৭শে মার্চ ২০১৭ ] নিত্য নতুন এসবের আবিষ্কার চলছে, উন্নয়ন চলছে। মানুষে-মানুষে, ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে যোগাযোগের মাঝখানেও আর কোনো কর্তৃপক্ষ-এনএসএ-নজরদারি চলতে পারবে না। অলরেডি সীমিত হয়ে আসছে। সুতরাং মানুষ কার সাথে কী নিয়ে যোগাযোগ করবে তা নির্ধারণের, নজরদারির ও নিয়ন্ত্রণের কোনো সরকারি আইন বা কর্তৃপক্ষ এখানে নাক গলাতে পারবে না। পারছে না ইতোমধ্যে। বিপুল মাত্রায়। বিশেষ করে পশ্চিম মহাদেশ।
 


ক্রিপ্টো অ্যানার্কির সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রভূত ‘কোড ইজ ল’ এর সমাজে তাহলে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের ওপর, তাদের মধ্যকার যেকোনো প্রকার লেনেদেনের ওপর কোনো প্রকারের বিধিনিষেধ আরোপের সুযোগ থাকবে না কারো। মানুষ আচরণ করবে, যোগাযোগ করবে, লেনদেন করবে স্বেচ্ছায়, স্বাধীনভাবে। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক হবে নতুন ধরনের। স্বাধীনতাভিত্তিক। মুক্তিপরায়ণ। সমাজ হবে স্বনির্ভর। স্বপরিচালিত।
 

এতক্ষণে গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়ার রাষ্ট্র-রূপান্তরের ধারণার সাথে – বা বাকুনিনের পুরানো সমাজের খোলসের ভেতর নতুন সমাজের বীজের বপন-অঙ্কুরোদ্গম-বিকাশ ঘটানোর ধারণার সাথে – জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জদের ক্রিপ্টো অ্যানার্কির ধারণার যোগাযোগ-সূত্রটাকে শনাক্ত করতে পারা যাচ্ছে আশা করি।
 

গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়া বলছিলেন: রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের বাইরে সমাজের মানুষেরা যতক্ষণ পর্যন্ত ‘ডিফারেন্টলি বিহেভ’ করতে না-পারছে, রাষ্ট্রবহির্ভূত স্বাধীন পন্থায় নিজেদের মতো করতে পারছে, স্বাধীন ও উন্নত মানুষের উপযুক্ত বলপ্রয়োগহীন সমাজ-সম্প্রদায়-কমিউনিটির নতুন নতুন নিউক্লিয়াস, কোষ ও দেহ (বর্তমান সমাজের খোলসের মধ্যেই) গড়ে তুলতে শুরু করতে এবং তার বিকাশ ঘটাতে না পারছে – ততক্ষণ আমরাই আসলে রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখছি। ততক্ষণ বিদ্যমান এই রাষ্ট্রপ্রথাকে নিন্দা করে লাভ নাই। কেননা, ততক্ষণ আমরাই এই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রকে বদলাতে গেলে তাহলে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক-লেনদেন-যোগাযোগের ঘটনাগুলোকে রাষ্ট্রনিরপেক্ষভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে। নতুন সমাজের চর্চা এখানেই করতে হবে। এখনই করতে হবে। তার জন্য চাই নতুন সম্পর্কমালা, নতুন যোগাযোগপ্রণালী, নতুন আর্থিক বন্দোবস্ত। বাস্তবে এগুলো কীভাবে গড়ে তুলতে হবে সেটা ল্যান্ডাওয়া জানতেন না। তিনি শুধু নতুন সম্পর্কভিত্তিক নতুন ধারার কমিউনিটি গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছিলেন। তাঁর প্রায় ৭০-৭৫ বছর পর এসে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জদের, তাঁদের পূর্বসূরীদের, এবং তাঁদের উত্তরসূরীদের ‘সাইফারপাঙ্কস’ ঘরানার ক্রিপ্টো অ্যানার্কি আমাদের সামনে গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়া কথিত নতুন সম্পর্ক, নতুন লেনদেন, নতুন যোগাযোগ, নতুন মুদ্রাব্যবস্থার বাস্তবায়ন ঘটাতে শুরু করার মাধ্যমে আমূল রূপান্তরপ্রবণ নতুন সমাজ-সম্প্রদায়-সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুরু করেছেন। এখানেই। এই পুরানো সমাজের মধ্যেই। এখনই।
 

এখন বাকিটুকু নির্ভর করছে আমাদের ওপর। আমরা যত বেশি করে ব্যক্তির ও সমাজের স্বাধীনতার গুরুত্ব বুঝব, সাধারণ ব্যবহারকারী হিসেবে যত বেশি করে আমরা আমাদের সেলফোনে, কম্পিউটারে এবং ইন্টারনেটে (আমাদের যোগাযোগে ও আর্থিক লেনদেনে) ক্রিপ্টোগ্রাফিক সফটওয়ার এবং তার উপযুক্ত মেশিন ও অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করব, কোড ডেভেলাপার হিসেবে আমাদের তরুণ প্রোগ্রামাররা যত বেশি করে আমাদের দেশের ও বিশ্বের উপযোগী ক্রিপ্টোগ্রাফির অনুশীলন করতে পারবে – তার ওপর নির্ভর করবে বলপ্রয়োগহীন ও স্বাধীন, মনুষ্যসন্তানের উপযোগী সুন্দর একটা বিশ্বসমাজের দিকে কত তাড়াতাড়ি আমরা এগিয়ে যেতে পারব। সমাজ রূপান্তরের প্রশ্নটা এখন আর মুখস্ত শাস্ত্র, তত্ত্ব, মতবাদ, কিংবা জিন্দাবাদ-জয়বাংলার মামলা নয়। এটা স্রেফ আপনার আমার উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্ন। নতুন পৃথিবীর উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে নিজেকে-নিজেদেরকে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার প্রশ্ন। যাঁরা এই প্রশ্নটাকে বিবেচনায় নেন না, নতুন সমাজ বিনির্মাণের প্রশ্নটা তার আসলে প্রায়োরিটির মধ্যে পড়ে না। তিনি ব্যস্ত আছেন অন্য কাজে। তাই বলে তাকে আমরা দোষ দিতে পারি না। দোষ দিতে পারি শুধু নিজেকেই। কী করছি আমি? কতটা করছি?

 

রচনা: রাজশাহী ১৬ই মে ২০১৫
প্রকাশ: দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ ঢাকা ১৭ই মে ২০১৫

 

হদিস

গুস্তাভ ল্যান্ডাওয়া, ১৯১০। Gustav Landaur, “Schwache Stattsmanner, Schwacheres Volk!”, Der Sozialist, June; included in his 2010 book Revolution and Other Writings: A Political Reader; Edited and translated by Gabriel Kuhn; Oakland, CA: PM Press.

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, ২০১২। Julian Assange, “A Call to Cryptographic Arms”, Cypherpunks: Freedom and the Future of the Internet, by Julian Assange with Jacob Appelbaum, Andy Müller-Maguhn and Jérémie Zimmermann. New York: OR Books.

সেলিম রেজা নিউটন, ২০১৩নয়া মানবতাবাদ ও নৈরাজ্য: এম এন রায়ের মুক্তিপরায়নতা প্রসঙ্গে। ঢাকা: আগামী প্রকাশনী।

 

ফেসবুক, ২৬-০৫-২০১৫

  PDF
 
 
 
 
Logo