দৈনিক সোনার দেশ, রাজশাহী, ০৮-০৬-২০১৩
পাবলো পিকাসো
অচেনা দাগ
চব্বিশতম অধ্যায়
কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করাটা সত্যি বেদনাদায়ক; কিন্তু আরও বড় আহাম্মকি হচ্ছে কর্তা-নির্বাচন করতে যাওয়াটা। কর্তা বদল করে লাভ নেই – জীবন বদল করি চলো।
প্যারিস ১৯৬৮-র দেয়াল-লিপি (কেন ন্যাব, ২০০৬)
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন চলছে। বড় বড় টাউনে-সিটিতে। মেয়র এবং কাউন্সিলর পদের নির্বাচন। রাজশাহী সিটির নির্বাচন নিয়ে এখানে কথা থাকবে। কিন্তু স্রেফ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে এ রচনা নয়। সিটি কর্পোরেশনগুলো বলতে গেলে সবই বিভাগীয় শহরে। জেলা শহরগুলোতে সিটি কর্পোরেশন নাই বললেই চলে। জেলা-উপজেলা-গ্রামে আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ইত্যাদি। সেগুলোর গুরুত্ব কম। সিটি কর্পোরেশনের গুরুত্ব বেশি। গ্রামের গুরুত্ব কম। শহরের গুরুত্ব বেশি – রাজধানী-শহরের গুরুত্ব আরো বেশি। গরিবের গুরুত্ব কম। বড়লোকের বেশি। সংখ্যাগুরুর গুরুত্ব কম। গুটিকয়ের বেশি। মেয়রের গুরুত্ব বেশি। কাউন্সিলরের গুরুত্ব কম। সাধারণ ব্যক্তি-মানুষের গুরুত্ব আরো কম। নাই-ই প্রায়। সে দিন এক রিকশাআলা বললেন, প্যান্টশার্ট-পরা লোক কর্পোরেশনে গেলে চেয়ারে বসতে দেয়। কথা শোনে। কথা বলে। কিন্তু লুঙ্গিপরা মানুষ খালিপায়ে সিটি কর্পোরেশনে গেলে ঘণ্টা-ঘণ্টা পার করে তার পর নেতা বলেন: ‘এই, আজকে আর সময় হলো না গো, পরে আরেক বার এসো ভাই।’ এইসব কমবেশিতন্ত্রই কি গণতন্ত্র? গণতন্ত্র তাহলে সমগুরুত্বতন্ত্র নয়! ভোটাভুটির গণতন্ত্র তাহলে কী বস্তু?
এই প্রশ্ন তোলা আজকের লেখার একটা প্রাথমিক উদ্দেশ্য বটে। এ রচনা আমাদের সার্বিক ভোটাভুটির গণতন্ত্র নিয়ে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র নিয়ে। গণতন্ত্র মানে দাঁড়িয়েছে গুটিকয় হোমরাচোমরা-ভালোমন্দ ব্যক্তিকে পাঁচ বছর পর পর একদিন ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা। তার জন্য হৈ-হট্টগোল-গুজব-টাকা-পয়সা-কানঝালাপালা। এরই কি নাম গণতন্ত্র? এ বস্তুই কি অ্যাব্রাহাম লিঙ্কনের ‘গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল’? নির্বাচনের ছলে-বলে-কৌশলে প্রতিষ্ঠিত গ্রাম-শহর-রাজধানীর সরকারগুলো কি ‘জনগণের সরকার’? নাকি বিত্তশালী-বড়লোকদের সরকার? এগুলো কি ‘জনগণের দ্বারা’ পরিচালিত সরকার? নাকি ক্ষমতাশালী খোক্কসদেরদের দ্বারা পরিচালিত সরকার? এগুলো কি ‘জনগণের জন্য’ নিবেদিত সরকার? নাকি জনগণের নামে ধনিক-বণিক-মানিকদের সেবা করার সরকার? এই পঞ্চবার্ষিক প্রচারণা-প্রতারণাকে ‘গণতন্ত্র’ বললে গুটিকয়ের গুণ্ডাতন্ত্র বলে কাকে? কতিপয়ের কোটিপতিতন্ত্র বলে কাকে?
এই ‘প্রচারণা’ শব্দটা নিয়ে কারো রাগ করার সুযোগ নাই। কিন্তু ‘প্রতারণা’ নিয়ে কেউ কেউ গোস্বা করবেন। কারণ তাঁরা সৎ মানুষ। আপত্তি করব না। সবাই অবশ্যই অসৎ নন। সৎ মানুষে দেশ ভর্তি বলেই দেশটা এখনও চলছে। এই কলি কালেও। কিন্তু ‘সততা’ তো যাঁর যাঁর নীতিনৈতিকতাবোধের স্বরচিত মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করে। আবার গুরুজন-রচিত দণ্ডবিধির সংজ্ঞার ওপরও নির্ভর করে বৈকি! পাঁচশ টাকা চুরি করে ধরা পড়লে ন্যায়দণ্ডধারী আলখাল্লা-ইউনিফর্ম-পরা আদালত তাঁকে চোর বলতে বাধ্য। আইনত। দণ্ডত। সবাই তাই-ই বলেন। কিন্তু ফরাসি দেশের পিয়েরে জোসেফ প্রুধোঁ বলতেন, সম্পত্তি মাত্রেই চুরি[১]। গান্ধী বলতেন, যে নিজের শ্রমে উৎপাদন করে খায় না, সে চোর।[২] আমার মতো পুঁচকে-বড়লোক কিংবা হাজার কোটি টাকার বৃহৎ-বড়লোককে কেউ চোর বলেন না। দেখা যাচ্ছে: সমস্যাটা তাহলে দণ্ডবিধির নয়, নীতিবোধের। ‘সততা’ সম্পর্কে যাঁর যাঁর সংজ্ঞার।
নির্বাচনে ‘ভালো’ মানুষকে নির্বাচন করাই সবার লক্ষ্য। ঢাক পিটিয়ে বলা হচ্ছে। সবাই তা বিশ্বাসও করে আসছেন। যুগ যুগ ধরে। ভালোমন্দের নীতিবোধ কী বস্তু? ভালো কী? মন্দ কী? হল্যান্ডের আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-
বিজ্ঞানী, বিশিষ্ট শ্রমিক-আন্দোলনকর্মী, মুক্তিপরায়ণ সমাজতান্ত্রিক পণ্ডিত প্রফেসর আন্টন পানেকুক কথাটা তুলেছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। প্রথম মহাযুদ্ধ, তার পরের বিভিষীকাময় মহামন্দা এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যে অমোচনীয় দেউলিয়াত্ব উন্মোচিত হয়েছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তুলেছিলেন প্রশ্নটা। তাঁর ‘ওয়ার্কার্স কাউন্সিলস’ নামের ধ্রুপদী গ্রন্থে। বইটা লেখা হয়েছিল ঐ ভয়ঙ্কর যুদ্ধের মধ্যেই। লিখতে লিখতেই চাকরি গিয়েছিল তাঁর। জার্মান ফ্যাসিবাদী সৈন্যরা হল্যান্ড দখল করে নেওয়ার পর। তো সেই বইতে প্রফেসর পানেকুক দেখিয়েছেন:
মানুষের ভালোমন্দের বোধ এবং ন্যায়বিচারের চেতনা কোনো আপতিক-আকস্মিক-আচমকা ঘটনা নয়। মানুষের মধ্যে প্রকৃতি-সূত্রেই এটা গড়ে ওঠে। অপ্রতিরোধ্যভাবে। জীবনধারণের মৌলিক সব শর্ত-পরিস্থিতি-অবস্থার অভিজ্ঞতা থেকেই গড়ে ওঠে এসব। সমাজকে তো বাঁচতে হয়। কাজেই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক-সম্বন্ধগুলো এমনসব নিয়মের অধীনে পরিচালিত হতে হয়, যাতে করে জীবনধারণের জন্য আবশ্যক সব জিনিস-পত্রের উৎপাদন-ধারা বিঘ্নিত না হয়। যেসব জিনিস জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয়ভাবে ভালো এবং দরকারি – সেগুলোই ন্যায়সঙ্গত, সঠিক। শুধু এই মুহূর্তের উপযোগী হলেই হবে না। সাধারণ অর্থে প্রয়োজনীয় হতে হবে। শুধু কতিপয় একক-ব্যক্তির জীবনধারণের জন্য হলেই হবে না। বৃহত্তর জনসাধারণের জন্য হতে হবে। পুরো সমাজ-সম্প্রদায়ের জন্য হতে হবে। ব্যক্তিগত বা স্বল্পস্থায়ী স্বার্থের জন্য হলেই হবে না। সকলের জন্য এবং দীর্ঘকালের জন্য সুস্থ, সুন্দর, উন্নতিশীল হতে হবে। জীবনধারণের শর্ত-পরিস্থিতি-অবস্থা যদি বদলায়, উৎপাদন-ব্যবস্থা যদি নতুন রূপ পরিগ্রহ করে, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক তাহলে বদলায়। ভুল কী আর সঠিক কী সেই সম্পর্কিত বোধও এসবের সাথে সাথে বদলায়। তখন আইনও বদলাতে হয়। (আন্টন পানেকুক, ১৯৪৬-এর পার্ট ওয়ান, ‘দ্য টাস্ক’ অংশ)
এর পর অসাধারণ সহজ ভাষায় প্রফেসর পানেকুক দেখিয়েছেন, ভুল-ঠিক, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের নীতিবোধের সাথে আছে আইন-আদালত-পার্লামেন্ট-কর্তৃপক্ষ এবং পুঁজিবাদ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির সুগভীর অবলীলাময় সম্পর্ক। সে আলোচনায় না গেলে নির্বাচনী গণতন্ত্রের অন্দরমহলের রূপ বোঝা কঠিনই হবে মনে হয়। কিন্তু সে আলোচনা অন্য দিন।
আপাতত একটু শুধু জেনে রাখা দরকার: চিন্তার এই ধারা বিপ্লবী মার্কসবাদ থেকে শুরু করে অ্যানার্কি পর্যন্ত বিস্তৃত। বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম পলের ‘রাষ্ট্র: এর উৎপত্তি ও কাজ’ (১৯১৭) এবং ধ্রুপদী নৈরাজ্য-তৎপরতার অন্যতম পূর্বসূরী পিওতর ক্রপোৎকিনের ‘রাষ্ট্র: এর ঐতিহাসিক ভূমিকা’ (১৮৯৭) গ্রন্থ দুটিতে এ ধারারই ভিত্তি রচিত হয়েছে। ফ্রান্স ও জার্মানির ‘কাউন্সিল কমিউনিজম’-এর ধারা এ জিনিসেরই অভিপ্রকাশ। ইউরোপ-জোড়া ‘মে ১৯৬৮’ আন্দোলনের বিপুল প্রবাহে এরই পলি পড়েছে। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা রোজা লুক্সেমবার্গ আর ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি আন্তোনীয় গ্রামসির সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা এ থেকে দূরবর্তী নয়। আধুনিক জমানায় ‘নৈরাজ্য’ শব্দটির রাজনৈতিক প্রণেতা ফ্রান্সের প্রুধোঁর শিল্পকারখানাভিত্তিক সমাজ-সংগঠনের ধারণায় এরই অনুরণন। মার্কস আর বাকুনিন তো ছিলেনই।
বিপ্লবী মার্কসবাদ থেকে শুরু করে সমাজতান্ত্রিক নৈরাজ্য পর্যন্ত পুরো এই ধারাটিকে মার্কিন অরাজপথিক প্রফেসর নোম চমস্কি ডাকেন ‘মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্র’ বলে। এই নাম তাঁর রচনা নয়। ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনে এ এক পুরোনো ধারা মাত্র। শুধু তাই নয়, পুঁজিবাদবিরোধী এই মুক্তিপরায়ণ সমাজতান্ত্রিক ধারার বীজ আছে ইউরোপীয় রেনেসাঁ থেকে উৎসারিত ‘ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী’ চিন্তাপ্রণালীতে। জার্মানির শিক্ষামন্ত্রী, ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের অন্যতম আদি দার্শনিক ও পণ্ডিত হমবোল্টের ‘রাষ্ট্রকর্মের সীমা’ তার একটা চিরায়ত দলিল। (দ্রষ্টব্য: নোম চমস্কি, ১৯৭০)
নির্বাচন আমাদের পঞ্চবার্ষিক উৎসব বটে। বৃহত্তম সেকুলার রাষ্ট্রীয় উৎসব। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-ভাষা-ধনী-গরিব নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণী-পেশার এবং পেশাহীন-বেকার মানুষজনের সর্বজনীন উৎসব এ। মিডিয়া কর্তৃক মহা-মহিমান্বিত, আইন কর্তৃক উদযাপিত এবং রাজনীতির রঙে অতিরঞ্জিত রাষ্ট্রীয় আতশবাজির মহোৎসব। কোটি টাকার জৌলুসে জমজমাট সম্পদ-ক্ষমতা-মর্যাদার পঞ্চবার্ষিক ভাগ্যনির্ণয়ের দিন। এর মাহাত্ম্য শবেবরাতের চেয়ে কম কীসে! (মাফ কোরো খোদা।) এই দিন দিবাগত রাত্রে ঘোষিত কে বা কারা গ্রাম-থানা-জেলা-সিটি-মেগাসিটি-দেশের পঞ্চবার্ষিক ইজারা পাবেন। ফ্রিস্টাইল ইজারা।
রাজনীতি হবে। উন্নয়ন হবে। রাস্তাঘাট হবে। অফিস-আদালত-বাজার হবে। ঠিকাদার পাবে। রাজনীতিবিদ পাবে। আমলারা পাবে। পেশাজীবীরা পাবে। এনজিওওয়ালারা তো পাবেই। কিন্তু আমজনতার এতে লাভ কীসে? কী পাবেন তাঁরা? তাঁদের কি অনাহার ঘুঁচবে? অশিক্ষা যাবে? বড় বড় রাস্তায় তাঁরা হাঁটতে ভয় পাবেন। ট্রাফিক পুলিশ দাবড়াবে। রিকশাচালক-অটোচালকরা তো বড় বড় জীপ-ট্রাক-পিকআপের কাছে ঘেঁষতেই পারবেন না।
তবু তাঁরাও পাবেন বৈকি। গণতন্ত্র বলে কথা! পাঁচটাকা-দশটাকা গুনতে গুনতে দিবস যাবে তাঁদের। কোনোদিন আল্লা চালাবেন। কোনোদিন নিজেরা চালাবেন– না খেয়ে অবশ্যই। মাস চালানোর টম-জেরি-টানাটানি আনন্দ দেবে। স্বপ্নে অভাবের দৈত্য আসবে। স্বপ্নে হিমালয় হাতছানি দেবে: একদিন আমরাও ... ওরকম সিনেমার মতো ... টিভির মতো ...। বিশাল শপিং মলের সামনে নিঃস্ব মানুষ গরিব মানুষ হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকবেন। এমনকি দশ টাকাও পেয়ে যাবেন। ভিক্ষা। সুখ হবে। সামন্ত রাজনীতি-ব্যবসা-পেশাদারির তালতো ভাই খালতো ভাইয়ের বংশলতিকার অতিসূক্ষ্ম সূত্র ধরে তাঁরা এমনকি তদ্বিরও করতে পারবেন। মেয়র-চেয়ারম্যান-কাউন্সিলের কাছে গিয়ে অভাব-অভিযোগ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান-প্যানপ্যান-মিনমিন করতে পারবেন। গণতন্ত্রই যেহেতু বিদ্যমান, ভবিষ্যতের ভোটের দুঃস্বপ্নে নেতারা তাঁদের দেবেনও বৈকি। মফিজ আর আবুলের কাছে সর্বস্ব হারানো দুই লাখ টাকা জমা দিয়ে এর দ্বারে ওর দ্বারে ঘুরতে থাকবেন তাঁরা। চাকরির আশায়। আশা মহান। আশাই তো প্রাণ।
তবু তাঁরা ভোট দিতে যাবেন। নাগরিক দায়িত্ব বলে কথা। টিভিতে বলেছে। পেপারে লিখেছে। ভোটের দিন, ভোটের আগে নগদ নারায়ণ, নগদ বিড়ি, নগদ পান-সুপারি, উপরন্তু নগদ মানসম্মানও জুটবে। এছাড়া, তাঁদের ভোটেই তো সবকিছু নির্ধারিত হবে। তাঁরাই তো সবকিছুর নির্ধারক। জনগণই তো সকল ক্ষমতার মালিক। সংবিধান বলেছে। গ্রামপিতা-নগরপিতা-জাতিপিতাদেরকে তো তাঁরাই বানান। তাঁরাই তো ইতিহাসের চালক। তাঁরাই তো সত্তরে ভোট দিয়ে বাংলাদেশ বানিয়েছে। জাতির পিতা বানিয়েছেন। তারপর থেকে পিতৃতন্ত্র। একচ্ছত্র। তার পর থেকে আব্বু-আম্মু-সমাচার। একেকটা নগরের লক্ষ লক্ষ মানুষের ‘আব্বা’ হবেন একজন মাত্র ব্যক্তি। সাথে তাঁরা পাবেন ৩০টা-৪০টা করে ‘বাবাতো ভাই’। আমার ভাই, তোমার ভাই, নীল ভাই, লাল ভাই। উড়ছে বাদুড়, দিচ্ছে সুর, ডিম্ব যাবে অচিনপুর। বেচারা জনগণ। তাঁদের কেউ কেউ পিতামহ-প্রপিতামহ হয়েও নাবালক থেকে যাবেন। দেশ চালানোর অধিকার পাবেন না। ভোট দেওয়ার আখেরি অধিকার তো পাবেন।
শাহবাগ এসেছিল। বাংলা-বসন্তের আবাহন শোনা গিয়েছিল। মানুষের প্রাণের কোকিল ডাক দিয়েছিল। চলে গেছে। গেছে রাজনীতি আর ভোট-ক্ষমতার ক্যালকুলেশনে। মাঝখান থেকে রয়ে গেছে কবিতা: ‘এখন থেকে আমাদের প্রত্যেককে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে হবে / এখন থেকে আমরা প্রত্যেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি’। থেকে গেছে অমর পঙ্ক্তি: ‘আমি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ / তোমরা সংসদ থেকে চলে যাও / আমি গাইবান্ধার জলো বিল থেকে উঠে এসেছি– এই দ্যাখো আমার পায়ে কাদা’।[৩]
কবিতার পাশাপাশি থেকে গেছে গান। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের। কবীর সুমনের। কত শত তরুণের। কবীর সুমনের গান তো পত্রিকাগুলো আস্ত আস্ত ছাপিয়ে দিয়েছে। টিভিচ্যানেলগুলোতে সেসবের মিউজিক ভিডিও-ও সম্প্রচারিত হয়েছে: ‘তিন মিনিটের জন্য শাহবাগ হলো দেশ’। তো, সেই সুমনের অন্য গানগুলোও কি ভোটের দিন বাজানো হবে নাকি? ভোটকেন্দ্রে? যেমন ধরুন এই গানটা:
ছোট্ট ছেলেটা তার টাকা আঁকে – রঙিন রঙিন নোট
এগুলোই হবে ব্যালট পেপার, বড়দের হলে ভোট
নোট নিয়ে খেলা ভোট নিয়ে খেলা ছোটতে বড়তে মিলে
জীবনের নোট নিয়ে গেছে ব্যাংক, ভোট নিয়ে গেছে চিলে
কিংবা ধরুন নিচের ‘হাউজ দ্যাট’ গানটার ‘মিউজিক ভিডিও’ বানিয়ে দেখানো হবে কি? টিভিতে? তাহলে আমাদের কষ্ট করে কল্পনা করতে হতো না, চোখের পর্দা খেয়ে টিভির পর্দায় দেখে নিতে পারতাম:
ছোট্ট রাজুর চোখ দুটো গেছে, হাউ’জ দ্যাট!
ভোটের সকালে লজ্জিত শুধু ক্রিকেট ব্যাট।
দেখুন, বড়রা, ঘাসও কতটা লজ্জা পান
লজ্জা কীসের? বোমাতন্ত্রটা চালিয়ে যান।
বাহবা সাবাস বড়দের দল এই তো চাই –
ছোটরা খেলবে, আসুন, আমরা বোমা বানাই
অথবা এই গানটার কথাও ভাবা যেতে পারে। কবীর সুমনের গান বলে কথা! ছাপানো হবে কি এ গান পত্রিকায় যেখানে তিনি নিজে বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের গলায় গেয়েছিলেন:
আগে ভোট দিন, পরে দেখা যাবে
ভোট গণণার পর কে পাবে কী পাবে।
পুরসভা ভোট, ভোট পঞ্চায়েতে –
জল আসবে কি বোরো ধানের ক্ষেতে?
জলসেচে টান মানে ভাতে পড়ে টান
পেটে খিদে নিয়ে বলো, এ দেশ মহান॥
আগে ভোট দিন ...
প্রচলিত ও সীমাবদ্ধ মানদণ্ড দিয়ে মাপলেও আমাদের মিডিয়া রীতিমতো অগণতান্ত্রিক। তাঁদের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণের প্রক্রিয়া আমলাতান্ত্রিক, হুজুর-হুকুম-বাজার-নির্ভর। মজার কথা হলো, কর্মচারী-সাংবাদিক কিংবা পাঠক-দর্শক-গ্রাহকদের ভোটে কদাচ নির্বাচিত হন না টিভি-মিডিয়া-পত্রিকার মালিক-সম্পাদকরা। নগদ টংকাই তাঁদের নগদ ব্যালটপেপার। রাজনৈতিক দলের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি-মহাসচিবরাও কর্মী-সদস্য-সমর্থকদের ভোটে নির্বাচিত হন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দ অথবা সেনাবাহিনীর জেনারেলগণ অথবা আদালতের বিচারপতিবৃন্দ কোনো প্রকারের ভোটে নির্বাচিত হন না। মজার ব্যাপার হলো এঁরা সকলেই ভোটের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। এঁরাই আমাদের ভোটপ্রথার বিশিষ্ট সব পালক-রক্ষক-প্রচারক। এঁদের প্রচারণা-দীক্ষায়ণ-শিক্ষায়ণের পাল্লায় পড়েই আমরা একটা গণবিরোধী কতিপয়তন্ত্রকে বলি গণতন্ত্র। হাততালি দিই। জিন্দাবাদ বলি। রাজনীতি, নির্বাচন, বুদ্ধিজীবিতা আর মিডিয়ার নিদারুণ এই দোস্তালির দীক্ষায়ণ-প্রকৌশল নিয়ে আরেক দিন কথা তোলা যাবে। আপাতত আস্ সালাম!
টীকাটিপ্পনী
[১] সবাই বলছেন, উইকিপিডিয়াও জানাচ্ছেন, ‘প্রপার্টি ইজ থেফ্ট’ কথাটা প্রুধোঁ ব্যবহার করেছিলেন তাঁর ‘সম্পত্তি কী?’ নামের রচনায়। এখন কৌতূহলবশত মূল অনুবাদটা (পিয়েরে জোসেফ প্রুধোঁ, ১৮৪০) ঘেঁটে দেখা গেল, মোটে ‘থেফ্ট’ শব্দটাই নাই গোটা বইটাতে। যা আছে, অনেক বার আছে, তা হলো, ‘প্রপার্টি ইজ রবারি’ – সম্পত্তি মানে দস্যুতা। ইংরেজি ‘রবারি’ শব্দটা মূল ফরাসিতে কীভাবে আছে তা পরে খুঁজে দেখার অবকাশ থেকে গেল।
[২] গান্ধীর নামে ব্যাপকভাবে প্রচলিত এই কথাটা আমি পেয়েছিলাম কলিম খানের কোনো একটা বইয়ে। মেলা ঘাঁটাঘাঁটি করে অবশেষে গান্ধী-রচনাবলী থেকে জানা গেল: নিজ শ্রমে উৎপাদন না করে খাওয়া মানে যে চুরি করে খাওয়া সে চিন্তাটা গান্ধী পেয়েছিলেন ‘রুটি-শ্রমের ধারণা’ থেকে। রুটি-শ্রমের এই ধারণাটা তিনি পেয়েছিলেন কালজয়ী রুশ সাহিত্যিক তলস্তোয়ের কাছ থেকে। তলস্তোয়ের মতে, ‘যে মানুষ শারীরিক শ্রম করে না সে আসলে চোর – সমাজ থেকে চুরি করে সে।’ বিস্তারিত জানাচ্ছেন গান্ধী স্বয়ং:
বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে অবশ্যই শ্রম করতে হবে – এই আইনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে তলস্তোয়ের রুটি-শ্রম সম্পর্কিত লেখালিখি থেকে। … ইংরেজি ‘ব্রেড লেবার’ কথাটার অনুবাদ হচ্ছে ‘জাতমেহনত’। আক্ষরিক অর্থে, এর মানে হলো রুটির জন্য শ্রম। মানুষকে তার রুটি জোগাড় করতে হবে অবশ্যই তার নিজের হাতে পরিশ্রম করে – এই ঐশ্বরিক আইনের ওপর প্রথম গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তলস্তোয় নন, টি. এম. বোন্দর্ফ নামের এক অল্প-পরিচিত রুশ লেখক। তাঁর কাছ থেকে তলস্তোয় এটা নেন এবং কথাটাকে কবুল করার মাধ্যমে তিনি একে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেন। আমার মতে, এই একই নীতি তুলে ধরা হয়েছে গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে। সেখানে আমাদেরকে বলা হচ্ছে, উৎসর্গ না করে যিনি খান তিনি চুরি-করা খাবার খান। উৎসর্গ বলতে এখানে স্রেফ রুটি-শ্রমকেই বোঝানো সম্ভব। (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩০: ৫৮)।
গীতার এই ব্যাপারটা গান্ধী পরে বুঝিয়ে বলছিলেন এভাবে: "গীতা আমি যতদূর বুঝি, এতে অনেক ধরনের যজ্ঞের কথা আছে। সেসবের একটা হলো কায়িক শ্রম। পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য যজ্ঞের মতো করে কায়িক শ্রম করা প্রতিটা বর্ণেরই কর্তব্য। কেউই এই যজ্ঞকে এড়াতে পারেন না। … যিনি এই শ্রমযজ্ঞ পালন করেন না প্রকৃতই তিনি একজন চোর। কায়িক শ্রম শুধু শূদ্রের জন্য প্রযোজ্য – এ কথা থেকে ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়।" (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, ১৯৩৩: ৪৩৪)
Schema and Logo: Salim Reza Newton
Home Pic: Childhood alphabet of Lalon Susmita Meera on wall
Developed by Fecund IT SolutioNs, Powered by UniqueIT