English | বাংলা
Logo
 

 

মিডিয়া-মাদক পার্টনারশিপ

সরন-প্রতিসরণ, ১১-০২-২০০৮

 


Artwork: Jean-Michel Basquiat

 

 

আদি প্রকাশের হদিস: বর্তমান রচনাটি আদিতে ছাপা হয়েছিলগণমাধ্যম পরিবীক্ষণের সহজ পুস্তক নামের একটি বইয়ের অংশ হিসেবে (সেলিম রেজা নিউটন, ২০০৮)। বইটা রচিত হয়েছিল ২০০৫ সালে এবং প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে ২০০৮ সালে। সেই বইয়ের “ভূমিকা ও সামগ্রিক ধারণা / মিডিয়ার ক্ষমতা ও মিডিয়া-পরিবীক্ষণ” নামক প্রথম অধ্যায়ের ভেতরকার “মিডিয়ার সামাজিক তত্ত্ব: মিডিয়া-পরিবীক্ষণের সামাজিক পরিসর” নামক দ্বিতীয় ভাগের (১.২ চিহ্নিত অংশের) খানিকটা জায়গা হুবহু তুলে নিয়ে বর্তমান রচনাটি গঠিত হয়েছে। এখানে তার একটা জায়গায় দুটো শব্দ আগে-পরে করা হয়েছে, কয়েকটা জায়গায় তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে দুয়েকটা শব্দ/তথ্য যোগ করা হয়েছে, এবং বইপত্রের হদিসের অনলাইন লিঙ্কগুলো নতুন করে পরীক্ষা করে আপডেট করা হয়েছে। এছাড়া কোথাও কোনো কিছু পরিবর্তন করা হয় নি। শিরোনাম পরে দেওয়া হয়েছে। — লেখক

 

মোট কথা হলো, মিডিয়া-পরিবীক্ষণ’ সামাজিক ক্ষমতা চর্চার পরিপ্রেক্ষিতবিহীন এবং তত্ত্ব-মতাদর্শ-নিরপেক্ষ কোনো প্রসঙ্গ নয়। এর সাথে সরকারী ক্ষমতা, বৃহৎ ব্যবসা ও বৃহৎ পুঁজি তথা মিডিয়ার মালিকপক্ষ, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন ইত্যাদি ইত্যাদির ঘনিষ্ট সম্বন্ধ আছে। কথাটা ভালো করে বুঝে নেওয়ার জন্যে এখানে আমরা একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ বা কেস একটুখানি বিশ্লেষণ করে দেখাবো। উদাহরণ হিসাবে আমরা নেবো মাদকাসক্তি আর ধূমপানের প্রসঙ্গ। এসব প্রসঙ্গ কেমন করে তুলে ধরে মিডিয়া? প্রথম আলো-র কথা বলা যায়। এই পত্রিকাটা যখন মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে সোচ্চার, ঠিক সেই সময়েই ধূমপানের কুফল সম্পর্কে নীরব— বরঞ্চ সিগারেটের বড় বড় বিজ্ঞাপন মহাসমারোহে প্রচারের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠ। সিগারেট কি মাদকদ্রব্য না? বিজ্ঞাপনের আতিশয্যে সিগারেটকে অনেকেই মাদকদ্রব্য বলে মনেই করেন না। কিন্তু ঘটনা হলো, সিগারেট খুবই মারাত্মক একটা মাদক। মাদক হিসাবে সিগারেটের ভয়াবহতা সম্পর্কে কয়েকটা তথ্য পেশ করা যাক।
 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য সেন্টার অন অ্যাডিকশান অ্যান্ড সাব্স্ট্যান্স অ্যাবিউজ অ্যাট কলাম্বিয়া’ ঘরে-ঘরে চালানো ব্যাপক গবেষণা থেকে দেখতে পেয়েছে, মদ আর গাঁজা আর সিগারেট হলো ‘গেটওয়ে ড্রাগ’। এগুলো হলো কোকেন, হেরোইন প্রভৃতি ভয়ঙ্কর মাদকের জগতে ঢোকার ‘দরজা’। (CASA, 1991)
 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ড্রাগ অ্যাবিউজ’ এর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যেসব পরিস্থিতিতে নিকোটিন-আকাক্সক্ষা আর অতিরিক্ত সিগারেট-আসক্তি তৈরী হয়, সেসব পরিস্থিতি থেকেই কোকেন আর হেরোইন গ্রহণের আকাক্সক্ষাও বেড়ে ওঠে। যেসব মাদকাসক্ত সিগারেটও খায়, মাদকনিরোধী চিকিৎসা তাদের বেলায় কম সফল হয়। চিকিৎসা-গ্রহণরত আফিম-আসক্ত রোগীদের মধ্যে দেখা গেছে, কোকেন আর আফিমের মাত্রার সাথে সিগারেটের মাত্রা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। (Patrick Zickler, 2000)
 

যুক্তরাজ্যের সরকারী গবেষণা-নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, সিগারেট খাওয়া মদ্যপানের সাথেও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত (Sarah Blenkinsop, 2001)
 

এ প্রসঙ্গে এখানে আমরা জাতিসংঘের বিশ্ব-স্বাস্থ্য-সংস্থার পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার আঞ্চলিক পরিচালক ড. শিগেরু ওমির লেখা থেকে আলাদা আলাদা কিছু জায়গার উদ্ধৃতি দেব। ধূমপানের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আমরা আমাদের মিডিয়া থেকে এসব তথ্য পাই না বললেই চলে। ফলে ড. শিগেরু ওমিকে বেশি করে উদ্ধৃত করতে হচ্ছে (নিচে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদগুলো আমরা মূল প্রবন্ধের ক্রমানুসারে রাখি নি, আগে-পরে করেছি আমাদের বোঝার সুবিধার কথা ভেবে।) ড. শিগেরু ওমি বলছেন:

 

কল্পনা করেন যদি কোকেন বৈধ করা হত, আর যুবা-তরুণদের কাছে দস্তুরমতো বাজারজাত করা হত, খেলার স্টেডিয়ামে যদি কোকেনের বিজ্ঞাপন দেওয়া হত, যদি ডিস্কো গানের আসরগুলোতে ফ্রি দেওয়া হত কোকেন, পপ কনসার্ট-গুলোতে প্রচারের জন্যে এটি তুলে ধরা হত এবং এমনকি যদি স্কুলে চোখের সামনে থাকত কোকেনের প্রচার-দ্রব্য? উদ্দেশ্য? উদ্দেশ্য হলো তরুণ-যুবারা যেন কোকেন নেয়— বলাই বাহুল্য। নিশ্চিত যে, সমস্ত জায়গায় মা-বাবাদের মধ্য থেকে তাহলে প্রতিবাদের মহা হাউকাউ লেগে যেত।

অথচ প্রত্যেকদিন প্রায় একই ধরনের ব্যাপার ঘটছে। তামাক কোম্পানিগুলো বাচ্চাদেরকে টার্গেট করছে চরম ধূর্ত আর দক্ষ মার্কেটিঙের সাহায্যে।

...

আপনি দাবি করতে পারেন যে তামাক কোকেনের মতো অতোটা বিপজ্জনক না। কথাটা ঠিক না। ভুল করবেন না: তামাক একটা মাদক। এবং এটা খুন করে। তামাক নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা, আসক্ত হয়ে পড়া এবং পরে অকালে মরে যাওয়ার সম্ভাবনা অন্য যেকোনো মাদকের চেয়ে বেশি। তামাক যদি আজকের দিনে আবিষ্কৃত হত, তাহলে তা কখনই বৈধ হত না।
...

ধূমপান বিপজ্জনক — এটা দুনিয়ার একক বৃহত্তম খুনি। সারা দুনিয়ায় প্রতি ১০টা মৃত্যুর ১টা হয় এর কারণে। সংখ্যাটা এইডস-এর চে বেশি। (Dr. Shigeru Omi, 2002)

 

আমাদের প্রথম আলো যখন মাদকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে তখনও এ-হেন ভয়ঙ্কর তামাক বা সিগারেটের বিরুদ্ধে বলতে গেলে টুঁ শব্দটাও করে নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি সচেতনভাবে, ধারাবাহিকভাবে প্রথম আলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরিবীক্ষণ করে দেখে তবেই এ-কথা বলছি। এখন প্রশ্ন হলো, যারা গাঁজা প্রভৃতির বিরুদ্ধে প্রায় হঠাৎ করে এত সাংঘাতিক রকম তৎপর তারা সিগারেটের বেলায় এতটা উদাসীন হয় কীভাবে? ব্যাপারটা কি আসলেই উদাসীনতা, জ্ঞানের অভাব, নাকি আর কিছু? বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত ও সমাজ-পরিবর্তনকামী মুক্তিমুখীন আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী নোম চমস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের মাদকবিরোধী যুদ্ধ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে অন্যান্য কথার পাশাপাশি স্বভাবসুলভভাবে খুব মজার কিন্তু খুবই চিন্তা করার মতো একটা কথা বলেছিলেন। কথাটা আমাদের আলোচনার জন্যে ভেবে দেখার মতো:
 

নিজেই নিজেকে আপনি একটা সরল প্রশ্ন করে দেখেন: এটা কীভাবে সম্ভব যে গাঁজা অবৈধ কিন্তু তামাক বৈধ? স্বাস্থ্যের উপর প্রভাবের কারণে এটা হতে পারে না। কারণ ঘটনা ঠিক তার উল্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নথিভুক্ত [রিপোর্টেড] ছয় কোটি সেবনকারীর মধ্যে গাঁজার কারণে কখনই সাংঘাতিক কিছু ঘটে নি। অথচ প্রতি বছর শত শত হাজার হাজার লোককে খুন করে তামাক। কীভাবে প্রমাণ করা যাবে আমি জানি না, কিন্তু আমার দৃঢ় সন্দেহ হয়— তামাক বৈধ আর গাঁজা অবৈধ হওয়ার কারণ হলো গাঁজা একটা আগাছা মাত্র। পেছনের উঠানে আপনি এটা জন্মাতে পারেন। সুতরাং, যদি এটা বৈধ করে দেওয়া হয় তাহলে এর থেকে টাকা-পয়সা কামানোর মতো লোক পাওয়া যাবে না। আর, তামাকের জন্য দরকার ব্যাপক পরিমাণ পুঁজি ও প্রযুক্তি এবং তা একচেটিয়ায় পরিণত করা সম্ভব। সুতরাং এমন অনেক লোক আছেন যারা এর থেকে এক টন টাকা কামাতে পারেন। এই দুইটা জিনিসের মধ্যে এই তফাতটা ছাড়া সত্যিই আর কোনো তফাত আমি দেখি না — তামাক গাঁজার চেয়ে অনেক বেশি প্রাণঘাতী এবং অনেক অনেক বেশি আসক্তিজনক। (Noam Chomsky, 2003a: 49)


চমস্কির তথ্যের সত্যতা যাচাই করার জন্যে তাঁর যে বই থেকে উপরের উদ্ধৃতিটা দিলাম সেই ক্ষমতাকে বোঝা বইয়ের ফুটনোটের ওয়েবসাইটে (Noam Chomsky, 2003b) ঢুকে দেখা গেল, ১৯৮৯ সালের বিজ্ঞান পত্রিকার একটা সংখ্যায় এথান এ. ন্যাডেলম্যান-এর একটা প্রবন্ধ থেকে চমস্কি স্বাস্থ্যের উপর গাঁজা আর তামাকের প্রভাব সংক্রান্ত তথ্যটা নিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘উড্রো উইলসন স্কুল অফ পাবলিক পলিসি’র প্রফেসর ন্যাডেলম্যান (Ethan A. Nadelmann, 1989: 943) জানাচ্ছেন, ছয় কোটি গাঁজাসেবনকারীর কেউই গাঁজা খাওয়ার জন্য মারা যায় নি। সমস্ত অবৈধ মাদক মিলিয়ে হিসাব করলে এদের কারণে ১৯৮৫ সালে মারা গেছেন মোট ৩৫৬২ জন। আর, শুধু তামাকের কারণেই গড়ে বছরে মারা যান ৩ লাখের বেশি লোক। [অন্য দিকে, মদের কারণে বছরে মারা যান ৫০ হাজার থেকে দুই লাখের মতো মানুষ; আর ফি বছর গাড়ি দুর্ঘটনায় গড়ে যে ৪৬ হাজারের মতো লোক মারা যান সেসব দুর্ঘটনার ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে মদ্যপান একটা কারণ হিসেবে কাজ করে।] চমস্কির আরেক সূত্র ফিলিপ জে. হিল্টস জানাচ্ছেন, শুধু পরোক্ষ ধূমপানজনিত ফুসফুসের ক্যান্সারে বছরে ৩ হাজার বা তার বেশি মানুষ মারা যায় (Philip J. Hilts, 1990)
 

কাজে কাজেই, চমস্কির যুক্তি তো না মেনে উপায় নাই! সিগারেট নিয়ে বৃহৎ ব্যবসাপতিরা আরেকটা বৃহৎ ব্যবসা ফাঁদতে পারেন। সিগারেট উৎপাদন একটা পুঁজিঘন প্রযুক্তি। একটা বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি হওয়া ছাড়া এর আর কোনো উপায় নাই। চাইলেও কারো পক্ষে ঘরে বসে সিগারেট উৎপাদন এবং/অথবা ভোগ করার রাস্তা নাই। সুতরাং ব্যবসাপতিদের পক্ষে সিগারেট বেচে কোটিপতি হওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু গাঁজার রকমসকমই এমন যে, এর পক্ষে বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রি হওয়া সম্ভব না। গাঁজার ব্যবসা যদি বৈধ করে দেওয়া হয় তাহলে গাঁজা বেচে ব্যবসাপতিদের পক্ষে বিশেষ একটা টাকা কামানো সম্ভব না। কারণ, যার দরকার সে তার ঘরের পেছনের উঠানেই গাঁজার গাছ লাগিয়ে দেবে, আর সারা বছর ঐ জিনিসের বলতে গেলে মাঙনা জোগান পাবে। এই জন্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সিগারেট বৈধ, কিন্তু গাঁজা অবৈধ। মনে রাখলে সুবিধা হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যে মহা-জেহাদে লাগাতারভাবে লিপ্ত আছে অনেক অনেক বছর ধরে সেটার তুলনায় প্রথম আলো-র তৎপরতা তুলনীয় কিছু নয়। মাদক-যুদ্ধ হচ্ছে আমেরিকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ — এর পেছনে খরচ হয় বছর-প্রতি ৫০ বিলিয়ন ডলার (Paul Armentano, 2001: 238)। ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ কর্তৃক ঘোষিত মার্কিন মাদক-যুদ্ধ এ-যাবত মাদকের সহজলভ্যতায় কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে পারে নি, মাদকের দামেরও হেরফের ঘটাতে পারে নি; মাদকাসক্ত হওয়ার হারও কমাতে ব্যর্থ হয়েছে এই মাদক-যুদ্ধ (Noam Chomsky, 1999)। এ-সব উদ্দেশ্য অর্জন করা অবশ্য এই মাদক-যুদ্ধের লক্ষ্য নয় মোটেও। এর লক্ষ্য আলাদা— জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা। বিপুল সংখ্যক বই-পত্র-প্রবন্ধ-নিবন্ধ-সাক্ষাৎকার-বক্তৃতায় নোম চমস্কি এবং আরও অনেকে মাদক-যুদ্ধের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে তথ্যবহুল আলোচনা করেছেন। কিন্তু সেই আলোচনা এখানে নয়।
 

সুতরাং, প্রফেসর নোম চমস্কির কাছ থেকে সহজে-কিন্তু-অকাট্যভাবে শেখা গেল যে প্রশ্নটা আসলে বৃহৎ ইন্ডাস্ট্রির, বৃহৎ পুঁজির, বৃহৎ ব্যবসার, আর ব্যবসাপতিদের মুনাফা কামানোর। মাদকের ব্যাপারটা তাহলে সরকার বা মিডিয়ার জন্যে আদৌ নীতিনৈতিকতার না! এই জন্যেই তাহলে মাদকবিরোধী রমরমা প্রচারাভিযানের কালেও সিগারেট সম্পর্কে প্রথম আলো রীতিমতো চেপে যায়! শুধু তা-ই না, মহাসমারোহে সিগারেটের বিজ্ঞাপনও ছাপতে থাকে নির্দ্বিধায়! এই বিষয়ে আবার ড. শিগেরু ওমিকে স্মরণ করা যেতে পারে:
 

সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখাচ্ছে যে বিজ্ঞাপন বাচ্চাদেরকে ধূমপানের মধ্যে টেনে আনে — তা না-হলে তামাক-সংস্থাগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন [ডলার] বাজি ধরতে যাবে কেন?
...


আপনি যুক্তি দেখাতে পারেন, ধূমপান যদি এতটাই বিপজ্জনক হয়, তাহলে এসব বিজ্ঞাপনকে অনুমোদন করা হয় কীভাবে? ভালো প্রশ্ন। আসলে, সর্বস্থানে দৃশ্যমান সিগারেট-বিজ্ঞাপন সম্ভবত এই ধারণা তুলে ধরে যে ধূমপান অতটা খারাপ কোনো জিনিস না। সাম্প্রতিক একটা ব্রিটিশ জরিপে দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের অর্ধেকই মনে করেন যে ‘ধূমপান নিশ্চয়ই অতখানি বিপজ্জনক ঘটনা নয়, সরকার তা হলে সিগারেটের বিজ্ঞাপন ছাপতে দিত না’।
...

এই হলো সেই পরিস্থিতি যা বিশ্ব-স্বাস্থ্য-সংস্থাকে বিশেষ একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রস্তাব করার দিকে ঠেলে দিয়েছে, যাতে করে তামাক সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন, করারোপ, শিক্ষা আর প্রতিষেধ সংক্রান্ত এমনসব বিধিবিধানের ব্যবস্থা করা যায় যা [বিশ্ব-স্বাস্থ্য-সংস্থার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে] আইনগতভাবে মেনে চলতে হবে। (Dr. Shigeru Omi, 2002)


জাতিসংঘের বিশ্ব-স্বাস্থ্য-সংস্থা বা ‘হু’ এই প্রস্তাব-উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক নাম দিয়েছে ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশান অন টোব্যাকো কন্ট্রোল’ (বা সংক্ষেপে, এফসিটিসি; এ-সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে হু-র ওয়েবসাইট দ্রষ্টব্য: WHO, 2005a)। এই সংক্রান্ত কাজকর্ম-উদ্যোগ-প্রচেষ্টা ‘হু’ চালাচ্ছে বহু বছর ধরে, বলতে গেলে ১৯৯৫ সাল থেকে (এই বিষয়ক ইতিহাস জানার জন্যে হু-র আরেকটা ওয়েবসাইট দেখা যেতে পারে: WHO, 2005b)।
 

এরই ধারাবাহিকতায় হংকং, কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম তামাক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশ্বকাপ এবং অলিম্পিক এখন স্পন্সরশিপের দিক দিয়ে তামাকমুক্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০০৬ সাল নাগাদ তামাকের যাবতীয় বিজ্ঞাপন আর স্পন্সরশিপ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। (Dr. Shigeru Omi, 2002)
 

এ-বছরের [২০০৫ সালের] ২৭শে ফেব্রুয়ারি থেকে এই এফসিটিসি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়েছে। এসবেরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার এ-বছরের ২৬শে মার্চ তারিখে প্রকাশ্যে ধূমপান এবং সিগারেটের বিজ্ঞাপন-বিরোধী আইন পাশ করেছে আমাদের জাতীয় সংসদে। কিন্তু এ-সংক্রান্ত তথ্যমূলক বা ব্যাখ্যামূলক রিপোর্টিং আমাদের দেশের মিডিয়াতে একেবারেই অনুপস্থিত। কেননা, তামাকের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হলো কেন, তা নিয়ে এই মুহূর্তে কথাবার্তা তুলতে গেলে মিডিয়া নিজেই বেকায়দায় পড়ে যাবে। প্রশ্ন উঠবে: এতদিন তাহলে তারা তামাকের মতো সর্বনাশা মাদকের বিজ্ঞাপন দেদারসে ছেপে গেলেন কোন যুক্তিতে? ফলত, মিডিয়ার গ্রাহকসমাজ ও নাগরিকেরা হঠাৎ করে একটা আইনের সামনে এসে পড়েছেন এবং নানাবিধ বিভ্রান্তি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারও কারও মনে সৃষ্টি হচ্ছে।
 

এ-অবস্থায় ধূমপান আর মাদকবিরোধী প্রচার নিয়ে যদি প্রথম আলো বা আরও সব পত্রিকা পরিবীক্ষণ করা যায় তাহলে অত্যন্ত জরুরি সব পর্যবেক্ষণ ও ফলাফল বেরিয়ে আসবে এবং তার মাধ্যমে সরকার, নাগরিকবৃন্দ, রাজনৈতিক দল, নানান সামাজিক ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান আর সর্বোপরি মিডিয়ার কর্তব্য নির্ধারণ করা খুব সহজ হবে।
 

কিন্তু শুধু বিজ্ঞাপনই না, সিগারেটওয়ালাদের প্রচারধর্মী কর্মকাণ্ডগুলোকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ‘নিউজ আইটেম’ হিসাবে দেখিয়ে নিজেকে সিগারেট কোম্পানি’র মিডিয়া-পার্টনারে পরিণত করে প্রথম আলো এবং আরও সব পত্রপত্রিকা। ফলে, ধ্রুপদী গানের ওস্তাদগণ সিগারেটকে গানের গলার জন্যে ক্ষতিকর হিসাবে মানা করেন, আর প্রথম আলো তার পাঠকদেরকে দিনের পর দিন ধরে জানাতে থাকে সঙ্গীতের তরুণ ‘প্রতিভা’ আবিষ্কারে বা বাংলাদেশে মিউজিকের প্রসারে বেনসন অ্যান্ড হেজেস-ওয়ালাদের মতো পৃষ্ঠপোষক আর নাই। শুধু তা-ই না, বাংলাদেশে ‘প্রতিভাবান’ তরুণদের চিত্রকলা চর্চার বিকাশেও অগ্রণী প্রতিষ্ঠানটার নাম যে ঐ ব্রিটিশ-অ্যামেরিকান টোব্যাকো (যাঁরা বেনসন অ্যান্ড হেজেস-এর মতো অভিজাত পরশপাথর-সিগারেট বেচে থাকেন; বেনসনের বিজ্ঞাপনের কথা স্মর্তব্য: ‘বি গোল্ড’ — বেনসন খেলে আপনি সোনা হয়ে যাবেন!) সেই কথাও প্রথম আলো-র ‘সংবাদ’ পাঠ করলে জানতে পারা যায় এবং সেটা সেই সময় যখন নাকি তারা মাদকবিরোধী জেহাদে অত্যন্ত দৃশ্যমানভাবে, ঢাকঢোল পিটিয়ে আত্মোৎসর্গ করেছেন।[১]
 

মিডিয়ার জন্যে এ-অবস্থাটা নতুন কিছু না, বা শুধু আমাদের দেশের অবস্থাই যে এ-রকম, তা-ও না। ড. ওমি জানাচ্ছেন, মালয়েশিয়ায় জাতীয় ফুটবল লিগ এবং ফিলিপাইনে প্রধান প্রধান বক্সিং ম্যাচ স্পন্সর করে তামাকওয়ালারা। এশিয়াতে ম্যাডোনা প্রমুখ টপ লেভেলের পপ তারকাদের নানান অনুষ্ঠানের খরচও তারা যুগিয়েছেন। সারা এশিয়া জুড়ে যুবা-তরুণদের টার্গেট করা হচ্ছে খেলাধুলা আর গানের প্রতি তাঁদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে। এই ধরনের বিপণন-কৌশলের লক্ষ্য হচ্ছে, যে-পণ্যটা মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী সেই পণ্যটারই একটা আকর্ষণীয়, উত্তেজনাপূর্ণ, অভিজাত আর ইতিবাচক ইমেজ দেওয়া। এমন একটা ইমেজ তরুণ-যুবাদের কাছে যার আবেদন আছে। (Dr. Shigeru Omi, 2002)
 

এখন আমাদের এখানে ধূমপানবিরোধী ও সিগারেটের বিজ্ঞাপনবিরোধী আইন পাশ হওয়ার পর প্রথম আলো-র ধূমপান বিষয়ক মনোভাবের যে-পরিবর্তন সূচিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, সেই এই পরিবর্তনকেও মিডিয়া-পরিবীক্ষণের আওতায় আনা যেতে পারে। আইনটার বিস্তারিত মুদ্রিত বিবরণ পাওয়া গেলে বোঝা যাবে, সিগারেটের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হলেও সিগারেট কোম্পানির স্পন্সরশিপ সম্পর্কে আইনে কী বলা আছে। এখনও ঐসব কোম্পানির মিডিয়া-পার্টনার হিসাবে প্রথম আলো বা এরকম অন্যসব পত্রিকা বা অপরাপর মিডিয়া তামাক কোম্পানিগুলোর প্রচারণামূলক স্পন্সরশিপ-কর্মকাণ্ডগুলোকে ‘নিউজ-আইটেম’ হিসাবে সার্ভিস দিচ্ছে কিনা তা-ও এ-সংক্রান্ত সম্ভাব্য মিডিয়া-পরিবীক্ষণের আওতায় আসার মতো প্রশ্ন। এ-রকম মিডিয়া-পরিবীক্ষণ মিডিয়ার পরিবেশনের ও প্রচারণার ক্ষমতাকে যেমন চোখে-চোখে রাখতে পারে, তেমনি খোদ মিডিয়ার কার্যকলাপ ও দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই ক্ষেত্রে পরিবীক্ষণের সামাজিক উপযোগিতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্নই উঠবে না যদি আমরা মনে রাখি,
 

এক শতাব্দী বা এ-রকম সময় আগেও আফিমের ব্যবহার ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। আজকের দিনে কেউই এর গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে যুক্তিতর্ক দেখাতে যাবে না। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাই হলো সেই জিনিস এখনও যা ধূমপানকে সফল, লাভজনক করে রেখেছে। (Dr. Shigeru Omi, 2002)


ধূমপান সংক্রান্ত মিডিয়া-পরিবীক্ষণ ধূমপানের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার এই ইস্যুটাকেই সামনে নিয়ে আসতে পারবে।
 

সুতরাং, মতাদর্শিক ও চিহ্নায়নের এজেন্সি হিসাবে মিডিয়ার ভূমিকা পরিবীক্ষণ করার সময় বিবেচনায় নিতে হয় পুরা সমাজটাকে, তার শ্রেণী-কাঠামোকে এবং শ্রেণী-আধিপত্যের রূপকাঠামোগুলোকে; অধিপতি মতাদর্শ-গুলো শাসক শ্রেণীর স্বার্থগুলোর প্রতিনিধিত্বই শুধু করে না, সেগুলো সবসময় খোদ জগতেরই একটা সামগ্রিক চেহারা-ছবি গড়ে দেয় (James Curran, Michael Gurevitch and Janet Wollacott, 1979)। এই চেহারা-ছবির আলোকে মিডিয়ার বার্তা-আধেয়কে বিবেচনা না-করলে মিডিয়া-পরিবীক্ষণের পক্ষে সত্যিকারের তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।

 

 

বইপত্রের হদিস
 

CASA (1991), “National Study Shows 'Gateway' Drugs Lead to Cocaine Use”, The Center on Addiction and Substance Abuse at Columbia (CASA), https://archive.is/HAn36 (originally retrieved on 22 January 2005; link updated and archived on 29 May 2018).

James Curran, Michael Gurevitch and Janet Wollacott (eds.) (1979), Mass Communication and Society, Beverly Hills/London: SAGE Publications.

Dr. Shigeru Omi (2002), “Advertising and Addiction of Asian Youth to Smoking”, The Korea Times, 03 June.

Ethan A. Nadelmann (1989), “Drug Prohibition in the United States: Costs, Consequences, and Alternatives,” Science, September 1, 1989, pp. 939-947, (This journal is published by American Association for the Advancement of Science), https://archive.is/jXNJE (link updated and archived on 29 May 2018).

Noam Chomsky (1999), "Debt, Drugs and Democracy" (Noam Chomsky interviewed by Maria Luisa Mendonca), NACLA Report on the Americas, Vol. 33, No. 1 Jul/Aug 1999 (March 12, 1999), https://archive.is/dOTxS (link updated and archived on 29 May 2018).

Noam Chomsky (2003a). Understanding Power: The Indispensable Chomsky, Edited by Peter R. Mitchell and John Schoeffel, First published in India by Penguine Books in 2003.

Noam Chomsky (2003b), www.understandingpower.com, This website contains explanatory footnotes of Noam Chomsky, 2003a, See footnote no. 32 of Chapter 2 of the footnote PDF book to be downloaded from https://archive.is/1zU0O (link updated and archived on 29 May 2018).

Patrick Zickler (2000), “Nicotine Craving and Heavy Smoking May Contribute to Increased Use of Cocaine and Heroin”, NIDA NOTES, Volume 15, Number 5 October 1, Nicotine Research, National Institute of Drug Abuses (USA), https://archive.is/32dSh (originally retrieved on 22 January 2005; link updated and archived on 29 May 2018).

Paul Armentano (2001), “Drug War Mythology” in Russ Kick (ed), The Disinformation Guide to the Media, https://archive.is/rVpTp (link updated and archived on 29 May 2018), New York: Disinformation Company Ltd.

Philip J. Hilts (1990), “Wide Peril Is Seen In Passive Smoking”, New York Times, May 10, 1990, p. A25, https://archive.is/TjzMH (link updated and archived on 29 May 2018).

Sarah Blenkinsop (2001), “Relationships between smoking, drinking and drug use”, Chapter 11 of the book Drug use, smoking and drinking among young people in England in 2001 (pp. 197-208), edited by Richard Boreham and Andrew Shaw, London: TSO, doc.ukdataservice.ac.uk/doc/4648/mrdoc/pdf/4648userguide2.pdf (originally retrieved on 4 Feruary 2006; link updated and archived on 29 May 2018).

WHO (2005a), “WHO Framework Convention on Tobacco Control (WHO FCTC)”, Printed by the WHO Document Production Services, Geneva, Switzerland, http://apps.who.int/iris/bitstream/10665/42811 /1/9241591013.pdf, https://archive.is/Y4N2G (originally retrieved on 05 April 2005; link updated and archived on 29 May 2018); for downloading the updated “Protocol to Eliminate Illicit Trade in Tobacco Products” published in 2013 by WHO FCTC the following link may be used: https://archive.is/adACR (originally retrieved on 29 May 2018; link archived on 29 May 2018).

WHO (2005b), “A history of the WHO Framework Convention on Tobacco Control”, https://archive.is/C89k1 (originally retrieved on 05 April 2005; link updated and archived on 29 May 2018).

সেলিম রেজা নিউটন (২০০৮)। গণমাধ্যম-পরিবীক্ষণের সহজ পুস্তক । ঢাকা: বাংলা একাডেমি।

 

 

চিত্রপরিচিতি

 

জন-মিশেল বাসকিয়াতের জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের ব্রুকলিনে ১৯৬০ সালের ২২শে ডিসেম্বরে। মারা গেছেন তিনি ১৯৮৮ সালের ১২ই আগস্ট ঐ শহরেরই ম্যানহাটানে, মাত্র ২৭ বছর বয়সে এবং তার আগেই রীতিমতো কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি তাঁর জীবনযাপন, মাদকাসক্তি এবং শিল্পকর্মের জন্য। কৃষ্ণাঙ্গ এই চিত্রকরের মা ছিলেন পুয়েরতো রিকো’র মানুষ। আর বাবা হাইতি’র তিনি সেখানকার ইন্টেরিওর-মিনিস্টারও ছিলেন।

বাসকিয়াত তাঁর বাল্য-কৈশোর-তারুণ্য ভ’রে ম্যানহাটানের শহরতলিতে বস্তির রঙচটা সব দালানে দালানে আঁকতেন ‘স্প্রে-পেইন্টিং গ্রাফিতি’ কখনো একা, কখনো বন্ধু আল দায়াজের সাথে মিলে, যৌথভাবে। এ ছাড়া কবিতা লিখতেন, গান বানাতেন, অডিও-ভিজুয়াল কিছু কাজও করেছেন। গ্রাজুয়েট হওয়ার আগের বছর স্কুল ছেড়ে ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন বাস্কিয়াত, ১৭-১৮ বছর বয়সে, ১৯৭৮-এর দিকে। শহরতলি ছেড়ে প্রবেশ করেন নিউ ইয়র্ক শহরে। জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করেন শহরের রাস্তায় রাস্তায় বন্ধুদের সাথে পোস্টকার্ড আর টি-শার্ট বেচে বেচে। বছর খানেকের মধ্যেই সুযোগ পেতে থাকেন লাইভ কেবল-শো আর টিভি-পার্টিগুলোতে। বানান গানের দল ‘গ্রে’। ক্লাবে ক্লাবে গান গাইতে থাকে তাঁর ব্যান্ড। অভিনয় করেন ‘ডাউনটাউন একাশি’ ওরফে ‘নিউ ইয়র্ক বিট মুভি’ নামের সিনেমায়। সেই সিনেমার সাউন্ডট্র্যাকে বাজানো হয় তাঁরই দলের গান।


বাসকিয়াতের চিত্রশিল্পের স্বাতন্ত্র্য ছিল খুবই স্পষ্ট। ব্যক্তির একান্ত গভীর বোধের সমাজ-সমালোচনামূলক ভাষ্য রচনা করতেন তিনি। পেইন্টিঙের সাথে ব্যবহার করতেন টেক্সট, ঐতিহাসিক তথ্য, আর গ্রাফিক্স। বিমূর্ত ইমেজের সাথে জুড়ে দিতেন ফিগারেটিভ অভিপ্রকাশ। রাগী এই ছেলের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ক্ষমতাকাঠামো আর বর্ণবিদ্বেষের পচে যাওয়া সিস্টেম। আর তাঁর কবিতা ছিল প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক উপনিবেশের সমালোচনা আর শ্রেণীসংগ্রামের প্রতি সমর্থনে ভরা। গ্রাফিতি বা দেওয়ালচিত্র এঁকেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এবং সেটা সত্তরের দশক ফুরানোর আগেই। আর তারপর আশির দশকে তো তিনি সুবিখ্যাত পেইন্টার।

বৃহত্তর পরিসরে আর্টিস্ট হিসেবে প্রথম নাম কামান ১৯৮১ সালে, ‘দ্য টাইম স্কয়ার শো’ নামের এক বহু-শিল্পী-সমবায়ে আয়োজিত চিত্র-প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে। ১৯৮১-তেই আর্টফোরাম ম্যাগাজিনে তাঁকে নিয়ে ‘দ্য র‌্যাডিয়ান্ট চাইল্ড’ নামে লেখা প্রকাশ করেন বিখ্যাত কবি, চিত্র-সমালোচক এবং সংস্কৃতি-কর্মী রেনে রিকার্ড। বাসকিয়াত উঠে আসেন চিত্রশিল্পের আন্তর্জাতিক দৃশ্যপটে। পরের বছরগুলোতে নিউ ইয়র্কে এবং অন্যান্য দেশে নানান চিত্র-প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি অংশ নিতে থাকে অন্যসব বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবির সাথে। বিখ্যাত গ্যালারিগুলোতেও ঠাঁই পায় তাঁর চিত্রকর্ম। অচিরেই, ১৯৮২ থেকেই, আরো সব শিল্পীর সাথে মিলে গড়ে ওঠে তাঁর চিত্র-আন্দোলন, ‘নয়া-অভিপ্রকাশবাদ’। ১৯৮৪ সাল থেকেই বাসকিয়াতের বন্ধুরা বিচলিত হয়ে পড়েন তাঁর অতিরিক্ত মাদক-ব্যবহারের কারণে। প্যারানয়া’র লক্ষণ দেখা দিতে থাকে তাঁর আচার-আচরণে। ক্রমবর্ধমান হারে হেরোইনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। নিউ ইয়র্কের আন্ডারগ্রাউন্ডে আরো সব পথশিল্পীদের সাথে একত্রে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি এসবে। ১৯৮৫ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারির নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আবির্ভূত হন বাসকিয়াত। তাঁকে নিয়ে তাতে লেখা ফিচারের নাম ছিল “নিউ আর্ট, নিউ মানি: দ্য মার্কেটিং অফ অ্যান অ্যামেরিকান আর্ট”। তাঁর আন্তর্জাতিক সফলতা উন্নীত হতে থাকে আরো উঁচুতে। ইউরোপের প্রধান প্রধান সব রাজধানী-শহরে অনুষ্ঠিত হতে থাকে তাঁর একক চিত্র-প্রদর্শনী। ১৯৮৮ সালের আগস্টে তিনি তাঁর নিজের স্টুডিওতে মারা যান হেরোইন আর কোকেনের সংমিশ্রণে বানানো ‘স্পিডবলিং’ নামে পরিচিত এক মাদকের বিষাক্ত ছোবলে। মৃত্যুর পর তাঁর জীবন নিয়ে বাসকিয়াত নামের সিনেমা বানান জুলিয়ান শ্ন্যাবেল।

১৯৯৮ সালে বাসকিয়াতের মূল একটা ছবি সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছে। ২০০২ সালে হেভি-মেটাল ব্যান্ড ‘মেটালিকা’র মালিকানায় থাকা তাঁর ‘প্রফিট ১’ ছবিটি বিক্রি হয় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন ডলারে। ২০০৭ সালে তাঁর শিরোনামহীন একটি চিত্রকর্ম বিক্রি হয় সাড়ে চৌদ্দ মিলিয়ন ডলারে। বর্তমান রচনার সাথে ব্যবহৃত তাঁর চিত্রকর্মটিকে তাঁর জীবনের শেষ চিত্রকর্ম বলে মনে করছেন চিত্র-বিশেষজ্ঞরা। এটি নিউ ইয়র্কের এক ড্রাগ ডিলারের দোকানের ইস্পাতের দরজায় এঁকেছিলেন তিনি।

 

 

পাদটীকা
 

[১] বর্তমান গ্রন্থটি [একদম ওপরের "আদিপ্রকাশের হদিস" অংশটি দ্রষ্টব্য] প্রকাশের সময়কালে, অর্থাৎ ২০০৮ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, এটি রচিত হওয়ার সময়কালে প্রকাশ্যে ধূমপান এবং সিগারেটের বিজ্ঞাপন-বিরোধী আইন পাশ হওয়ার (২০০৫ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে) পর থেকে মিডিয়া তামাকের বিজ্ঞাপন ছাপা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতি বছর ৩১শে মে তারিখে তামাকমুক্ত দিবস-(বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ঘোষিত ‘ওয়ার্ল্ড নো টোব্যাকো ডে’) তামাকের কুফল নিয়ে খবরাখবরও একটু একটু করে ছাপতে শুরু করেছে আমাদের মিডিয়া। নিজেদেরকে ‘ক্লিন’ মাদকবিরোধী হিসেবে দেখাতে এখন তাদের সুবিধাই হয়েছে। কিন্তু, জাতিসংঘের লাগাতার চেষ্টায় অন্যান্য দেশে জারিকৃত একই ধরনের আইনের পাশাপাশি বাংলাদেশেও জারিকৃত এই আইনের আগে পর্যন্ত সারা দুনিয়ার অধিপতি ধারার মিডিয়া তামাকের বিজ্ঞাপন ও স্পন্সরশিপ নিয়ে যে-কলঙ্কজনক ভূমিকা পালন করে গিয়েছে, তা তাদের কথা-কাজের অসঙ্গতি ও স্ববিরোধিতার দলিল হয়ে রইবে।

 

 

 

 

 
 
 
 
 
Logo