দৈনিক সোনার দেশ, রাজশাহী, ০৯-০৩-২০১৩
নেট থেকে সংগৃহীত। জলছাপে পাতার নাম দেওয়া আছে, ছিলই।
অচেনা দাগ
আঠারোতম অধ্যায়
১৮.১ আমাদেরকে কেন রাস্তায় লাশ হতে হবে?
যায়যায়দিন পত্রিকার বিশেষ একটি রিপোর্টের জন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলা এবং পরে ঐ পত্রিকায় ২রা মার্চে মুদ্রিত আমার কথাগুলো একটি নোট আকারে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। অন্যদের মধ্যে কানাডায় উচ্চশিক্ষারত আমাদের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থীও সেই নোটটি শেয়ার করেছিলেন। ফেসবুকে শেয়ারকৃত সেই নোটের নিচে মন্তব্যের ঘরে তাঁর এক বন্ধু গত ৩রা মার্চে লিখেছেন:
আমি মোটেও কোনো ছাগুকে [মুক্তিযুদ্ধবিরোধীকে] সাপোর্ট করছি না।
আমি নিজেও দুই বার শাহবাগ গিয়েছি। কিন্তু এখন যাচ্ছি না। আমার মতো আরো অনেকেই তাই করছে। তোরা বাইরে থেকে যা জানছিস, আর আমরা যা দেখছি, তার মধ্যে পার্থক্য অনেক যা তোকে বলে বুঝাতে পারব না। প্রতিদিন অগণিত মানুষ মারা যাচ্ছে, তারা সবাই কি যুদ্ধাপরাধী? গুলিবিদ্ধ ভাবীকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল যে ছেলেটি তাকে ধরে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলেছে। ৬০ বছরের বৃদ্ধ লোকটি চা খেতে রাস্তায় এসেছিল, বোমার আঘাতে রাস্তায় পড়ে মরে থাকল, ওদের কী দোষ ছিল?
এই ভদ্রলোককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু তাঁর কথা, আর অসহায় অনুভূতি আজ বাংলাদেশের আপামর মানুষের অনুভূতি। ফেসবুকে তিনি তাঁর ১লা মার্চের স্ট্যাটাসে আরো লিখেছেন:
আমরা কীসের মাঝে আছি জানি না। যেখানে আছি, সেখানে থাকতে পারব কিনা তা-ও জানি না। সকালে যখন বাসা থেকে বের হই, অফিস যেতে পারব কিনা তা যেমন জানি না, তেমনি অফিস থেকে বাসায় ফিরতে পারব কিনা তা-ও জানি না। বিচার হবে, শাস্তি হবে। সব ঠিক আছে, কিন্তু আমরা কী দোষ করেছি? আমাদের বাবা কী দোষ করেছেন? আমাদেরকে কেন রাস্তায় লাশ হতে হবে? গতকাল সন্ধ্যায় মিরপুরে ৬০ বছরের যে বৃদ্ধ লোকটি মারা গেলেন, তার কী দোষ ছিল? নোয়াখালিতে হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিল, তারা কী দোষ করেছে?
এই মুহূর্তের বাংলাদেশের এ এক মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন বটে। সামান্য, সাধারণ মানুষের লেখা। আমরা যাঁরা শত্রু শত্রু খেলার ডামাডোলে এখনও পুরোপুরি জ্ঞান হারাই নি তাঁরা কি মানুষের এই অসহায়ত্ব অনুভব করতে পারছি?
কী অবস্থা এখন বাংলাদেশের? বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে না। গরিব মানুষ পেটের দায়ে রিকশা নিয়ে, অটো নিয়ে, দৈহিক শ্রমশক্তিটুকু নিয়ে বাইরে বেরুতে পারছেন না। ব্যবসাবাণিজ্য উৎকণ্ঠায়। কৃষিকাজ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পথে। প্রত্যেকটা মানুষ আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছেন। আমার ষাটোর্ধ্ব অসুস্থ মা কাতর কণ্ঠে ঢাকা থেকে জানতে চাইছেন রাজশাহীতে আমাদের অবস্থা কী? টেলিভিশনের-পত্রিকার খবর পড়া বা দেখা অসহ্য মানসিক চাপ তৈরি করছে। ও দিকে, ২৫ হাজার পর্যটক কক্সবাজারে আটকা পড়ে আছেন (নিউ এজ, ৩রা মার্চ)। একের পর এক লাগাতার হরতালে স্থবির হয়ে পড়ছে দেশ। আমরা আবার পিছিয়ে পড়ছি।
জামায়াত এবং বিএনপি আহুত মোট ৬০ ঘণ্টার লাগাতার হরতালের প্রথম দিনেই বগুড়ায় থানায় থানায় ফাঁড়িতে ফাঁড়িতে হামলা, র্যাবের গাড়িতে হামলা, রেলস্টেশনে ও বাণিজ্যমেলার স্টলে স্টলে আগুন, কুরিয়ার সার্ভিসে হামলা হচ্ছে (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম, ৩রা মার্চ)। সিলেটে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকে; রাজশাহীর গোদাগাড়িতে পুলিশ-জামায়াতের সংঘর্ষে মারা গেছে নয় বছরের মাসুম বাচ্চা (প্রথম আলো, ৩রা মার্চ)। রাজশাহীতে ট্রেনে আগুন, সীতাকুণ্ড-ফেনী-লালমনিরহাটে রেললাইনে আগুন, আর ফিসপ্লেট ও স্লিপার খুলে ফেলার ঘটনা ঘটছে; নোয়াখালিতে রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে; অন্যত্র একই কারণে দুর্ঘটনায় পড়েছে আন্তনগর ট্রেন মহানগর গোধুলী (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম, ৩রা মার্চ)। কুমিল্লাতেও উপড়ে ফেলা হয়েছে রেললাইন; চাঁপাইয়ের শিবগঞ্জে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মতো একটা জায়গায় কার্যালয়, গুদাম ও আবাসিক এলাকায় আগুন ও লুটপাটের অকল্পনীয় তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ৪৮টি পরিবার; সেখানে ১৫টি ইউনিয়নের ৫৮ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায়; ভেঙে পড়েছে বোরো খেতের সেচব্যবস্থা (প্রথম আলো, ৩রা মার্চ)। পুলিশকে যেভাবে মাথায় খন্তা ঢুকিয়ে হত্যা করা হচ্ছে তা পৈশাচিক। আবার, পুলিশ যেভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে খুন করছে সেটাও রক্তবন্যার মতোই বটে।
পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, আরও যাচ্ছে। চট্টগ্রাম সিলেট নিলফামারীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় জামায়াত-বিডিআর-পুলিশের সহিংসতায় আরো ৪ জন নিহত হয়েছেন ২রা মার্চ (ইত্তেফাক, ৩রা মার্চ)। মাত্র এক মাসের মধ্যে, বলতে গেলে কয়েক দিনের মধ্যে, এ পর্যন্ত খুন হলেন কমবেশি অর্ধশতাধিক মানুষ (ইমদাদুল হক মিলন, কালের কণ্ঠ, ৩রা মার্চ)। আসলেই কত জন খুন হয়েছেন তার কোনো তালিকা কারো কাছে নাই। কেউ বলছেন ৩৭ থেকে ৪৫ জন নিহত হয়েছেন (ডেইলি স্টার, সম্পাদকীয়, ৩রা মার্চ), কেউ বলছেন ৪০ জন (প্রথম আলো’র সম্পাদকীয়, ৩রা মার্চ), কেউ বলছেন শুধু গত বৃহস্পতি-শুক্রবারে খুন হয়েছেন কমপক্ষে ৪৭ জন (নিউ এজ, ৩রা মার্চ), আবার কেউ বলছেন ৫৯ জন মানুষ এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন (সম্পাদকীয়, নয়া দিগন্ত, ৩রা মার্চ)। এর সাথে যোগ করুন জামায়াতের ৪৮ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে নিহত ২৩ জন (সোনার দেশ, রাজশাহী, ৪ঠা মার্চ ২০১১) এবং ২য় দিনে আরো ৩ জন মানুষ (ডেইলি স্টার, ৪ঠা মার্চ)। লাশ গুণে নামতা শেখার পাঠশালা খোলা হবে অচিরেই। ক্ষমতার চূড়ায় বসে এসএসএফ-নিরাপত্তায় থেকে দেশের অবস্থা কি বুঝতে পারছেন আমাদের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীরা?
গুরুতর অবিবেচনার সাথে পাইকারি হারে গুলি করে পাখির মতো মানুষ মেরে ফেলার জন্য সরকারকে ধিক্কার দেওয়ার কোনো বিকল্পই নেই। পুলিশের যদি নিতান্তই আত্মরক্ষার প্রয়োজন পড়ে তাহলে ফাঁকা গুলি কিংবা বড়জোর হাঁটুর নিচে গুলি করতে হবে, এটাই চিরকালের পুলিশী রেওয়াজ। আত্মরক্ষার জন্য গণহারে বুক বরাবর গুলি করছে পুলিশ কোন যুক্তিতে? এ রীতিমতো রাষ্ট্রীয় বিভীষিকা। যুদ্ধাপরাধীদের সন্ত্রাসপন্থার বিপরীতে এই রাষ্ট্রীয় সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়।
১৮.২ সর্বদলীয় দুষ্কৃতকারীদের সুবর্ণ সময়
যাঁরা সর্বদলীয় দুষ্কৃতকারী তাঁদের জন্য এটা সুবর্ণ সময়। যাঁরা অন্ধ-বিশ্বাসী এবং অন্ধ-অবিশ্বাসী তাঁদের জন্য এটা রীতিমতো আনন্দের উপলক্ষ্য। এই সুযোগে ডাকাতি বাড়বে, নাশকতা বাড়বে, অপরাধ বাড়বে। দোষ হবে জামাত-শিবিরের; দোষ হবে সরকারের। উভয় পক্ষ উভয় পক্ষকে দোষ দিতে পারলেই দায়িত্বমুক্ত হবেন, হয়ত আনন্দিতও হবেন। মরবে সাধারণ ‘কর্মী’রা মানুষ, আর গরিব পুলিশ। ও দিকে, গত বৃহস্পতিবার থেকে বাগেরহাট, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় শুরু হয়ে গেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর, এবং তাঁদের প্রতিমা, ধর্মস্থান ও বাড়িঘরে বীভৎস আক্রমণ। চরম দুঃখজনকভাবে এই ঘটনাকে সরকারী ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। এভাবেই চলতে থাকবে পারস্পরিক দোষারোপের নোংরা রাজনৈতিক খেলা। আরও বাড়বে। শনিবারে গাজীপুর বরিশাল নেত্রকোনা লক্ষ্মীপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরও হামলা হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরস্ত্র মানুষের ওপর (প্রথম আলো, ৩রা মার্চ)।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যথাযথভাবেই জামাত-শিবিবের তাণ্ডব, খালেদা জিয়ার একপেশে বক্তব্য এবং সরকারের পাইকারি গুলিবর্ষণের নিন্দা করেছে (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম, ৩রা মার্চ)। উভয় পক্ষকে তাঁরা সহিংসতা বন্ধে উদ্যোগ নিতে আহবান জানিয়েছেন; আর বাংলাদেশে এই সহিংসতায় জাতিসংঘ মহাসচিব পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন (ইত্তেফাক, ৩রা মার্চ)। ওয়াশিংটনে প্রেস ব্রিফিঙে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বলা হয়েছে, সহিংসতা কখনো প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না; এবং আশা প্রকাশ করা হয়েছে যে সরকার পরিস্থিতি শান্ত করতে পদক্ষেপ নেবে; ইউরোপিয়ান ইউনিয়নও এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা মেনে নেওয়া যায় না বলে মত দিয়ে বলেছে এতে কেবল দেশের উন্নয়ন বিঘ্নিত হয় (সমকাল-এর সম্পাদকীয়, ৩রা মার্চ)।
প্রসঙ্গত, র্যাব-চিতা-কোবরা দিয়ে বেআইনী হত্যাকাণ্ডের মচ্ছব চলে আসছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের গত কয়েকটা সরকারের নেতৃত্বে। সাথে, বিডিআর-বিদ্রোহের দায়ে আটক বন্দিদের মধ্যে বিচারের আগেই সেনা সরকারী সংস্থাসমূহের স্রেফ ‘জিজ্ঞাসাবাদে’ মারা গেছেন ৪৭ জন। বেআইনী হত্যাকাণ্ড কি তাহলে আরো আগে থেকেই এদেশে নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়ে যায় নি? আজ কি এসবেরও কুফল ঘটতে দেখছি না আমরা?
দেশ অচল হলে আমাদেরই ক্ষতি। আর যাবতীয় দুষ্কৃতকারীর লাভ। ইতোমধ্যে জামায়াত বিনষ্ট করছে গরিব এই দেশের অবকাঠামো। এরপর দেশের কী-পয়েন্ট-ইন্সটলেশনগুলো আক্রান্ত হলে কে রক্ষা করবে? পুলিশ? বিডিআর? থানা পুলিশ-কারাগার দিয়ে সহিংসতা থামানো যায় না। পুলিশ কোনোদিন মানুষকে শান্তি-স্বস্তি দিতে পেরেছে? এরশাদ আমলে কি আমরা দেখি নি? আমরা অল্প কিছু তরুণ কি সেদিন মেশিনগান তাক করে রাস্তায় নামা সেনাদলকে রুখে দিই নি? সরকার যদি পুলিশ দিয়ে শান্তি কায়েম করার স্বপ্ন দেখে থাকে তাহলে তা অসার দিবাস্বপ্ন মাত্র। এখন থানা রক্ষা করার জন্য সেনা মোতায়েন করতে হচ্ছে (বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডট কম, ৩রা মার্চ)। বিডিআর (বিজিবি) তো আগেই নেমেছে মাঠে। আমরা কি আবার সবাই মিলে এক-এগারো ডেকে আনছি না? ইতোমধ্যে বিবিসি’র বাংলা-বিভাগ বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ ছেপেছে (বিবিসি বাংলা, অনলাইন: মূল পাতা, ৩রা মার্চ)।
সব মৃত্যুই তো মৃত্যু। সব মৃত্যুতেই মায়ের কোল খালি হয়। জামাত-শিবিরের হাতে কেউ খুন হয়েছেন মনে হলে মিডিয়া যেভাবে তা কভার করছে, তার বিপরীতে জামাত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা, এবং গণ্ডগোলের মধ্যে পড়ে মরা সাধারণ মানুষেরা, ডজন ধরে খুন হলেও তা নিয়ে কোনো মানবিক আবেদনপূর্ণ সংবাদ-কাহিনী নাই। প্রায় সব পত্রিকাকেই এখন এরশাদের ‘দৈনিক বাংলা’ মনে হচ্ছে। প্রায় সব টিভি-চ্যানেলকেই এখন ‘বিটিভি’ মনে হচ্ছে। আমরা এগুচ্ছি, না পিছাচ্ছি? প্রচারণার অন্ধকারে প্রতিদিন খুন হচ্ছে সত্য-সততা-বিবেক। এই অবস্থা আমাদের যেখানে নিয়ে যাবে সেখান থেকে ফেরার কোনো পথ কি সরকারের বা জামায়াতের বা প্রধান বিরোধী দলের আদৌ জানা আছে?
এদিকে বিরোধী দলের নেত্রীর সমালোচনায় শাহবাগ-সমাবেশের মুখপাত্র ডা. ইমরানকে দেখছি কথা বলছেন সরকারী দলের নেতাদের ভাষায়। আর তাঁদের সমাবেশে এতদিনকার নির্দলীয় অহিংস-নীতির ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে গিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন বাঁশের লাঠি নিয়ে মাঠে নামার কথা (প্রথম আলো, ৩রা মার্চ)। এই সমাবেশের নেতৃত্ব চলে গেছে এখন সরকারী এবং সরকারী পক্ষের অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতাদের হাতে, যাঁদের ডাকে সাধারণ তরুণ-যুবা ছাত্ররা কোনো দিন সাড়া দেয় নি। এই সব বন্ধ করা না হলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে শাহবাগ-সমাবেশ। সে পরিণতি ঘটার আগেই তরুণ নির্দলীয়, রাজনীতি-প্রতারিত তরুণ প্রজন্মকে ভাবতে হবে নতুন উপায়ে সংগঠিত হওয়ার কথা।
শুধু তাই নয়, হাসপাতাল-ব্যাংক তো বটেই, পত্রপত্রিকা পর্যন্ত বন্ধ করার দাবি করছেন আজকের রাষ্ট্রপক্ষ শাহবাগ-সমাবেশের নেতারা, পত্রিকা-সম্পাদককে গ্রেপ্তারের সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছেন তাঁরা। এগুলো আত্মঘাতী চিন্তা। কেউ মিথ্যা লিখলে আপনি সত্য লিখুন। কথা দিয়ে কথাকে মোকাবেলা করতে পারতে হবে। রাষ্ট্রকে সেধে এনে পত্রিকা নিষিদ্ধ করা শেখানো যাবে না। মনে রাখতে হবে: ভিন্নমতের স্বাধীনতা ছাড়া স্বাধীনতা কথাটাই অর্থহীন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বহু লড়াইয়ের পর আমরা মিডিয়ার সীমিত স্বাধীনতা অর্জন করেছি। প্রতিপক্ষকে দমনের নামে এ স্বাধীনতাকে জলাঞ্জলি দেওয়া বিপজ্জনক কাজ। একবার নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমরা আবার সামরিক স্বৈরাচারের মতো নব্য-স্বৈরতন্ত্রী অন্ধকারের অতলে নিমজ্জিত হবো। প্রসঙ্গত, বিনা বাধায় সাংবাদিকদেরকে কাজ করতে দিতে হবে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিবের পক্ষ থেকে তাঁর মুখপাত্রও (ইত্তেফাক, ৩রা মার্চ)।
১৮.৩ দরকার ব্যাপক জাতীয় ঐকমত্য
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নে, সারা দেশের শান্তি-স্বস্তির প্রশ্নে, এই মুহূর্তে দরকার ঐকমত্য। ব্যাপক জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কবে কোথায় হয়েছে? কবে কোথায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরে এরকম অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে? এ কথা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, আন্তরিকভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার করা এক ব্যাপার, আর নির্বাচনে জেতার জন্য মানুষের মুক্তিযুদ্ধ-আবেগ নিয়ে রাজনীতি করে ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হওয়া আরেক ব্যাপার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষ-বিপক্ষ সকলেই আড়চোখে তাকিয়ে আছেন রাষ্ট্রক্ষমতার মসনদের দিকে। ‘‘যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই উপযুক্ত বিচার হওয়া দরকার। উদ্যোগটা আওয়ামী লীগ নিয়েছে বলে তাদের অভিনন্দন। কিন্তু বিএনপিসহ সব দলকে নিয়ে উদ্যোগটা হলে বেশি ভালো হতো। প্রশ্নটা জাতীয়, দলীয় নয়।’’ হ্যাঁ, একাত্তরে জামায়াতের তথাকথিত ‘‘ ‘ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান’ বোধগম্য কিন্তু জনসাধারণের বিরুদ্ধে গণহত্যা-গণলুণ্ঠন-গণনির্যাতনের কর্মকাণ্ডে সুসংগঠিতভাবে অংশগ্রহণ করা একদম বোধগম্য নয়। তাদের উচিত চিহ্নিত নরঘাতকদের দল থেকে বহিষ্কার করে, দল হিসেবে একাত্তরের অপরাধ স্বীকার করে, জাতির কাছে আন্তরিকভাবে, বিনীতভাবে মাফ চেয়ে শান্তির পথে ফিরে আসা।’’ তাদের উচিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্নটিকে নীতিগতভাবে মেনে নেওয়া, যুদ্ধাপরাধীকে দল থেকে বহিষ্কার করা, এবং তাদেরকে বাঁচানোর জন্য সারাদেশে নাশকতা সৃষ্টির পথ থেকে সরে শান্তির পথে ফিরে আসা। তারপর ভিন্ন নামে, ভিন্ন একটি গণতান্ত্রিক একটি দল হিসেবে নিজেদেরকে পুনর্গঠন করে সুস্থ রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ তাঁদের জন্য থাকা উচিত বৈকি। কেননা তাঁরা যখন সংগঠনগতভাবে, পাবলিকলি, আন্তরিক স্বরে আপামর দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইবেন, তখন তাঁদের একাত্তরের অপরাধমূলক অবস্থান পরিপূর্ণভাবে ভুল প্রমাণিত হবে। আর যদি তাঁরা মন থেকে ক্ষমা না চেয়ে লোক দেখানো কৌশলের ক্ষমা চান, তাহলে তাঁদের ইসলামের নামে, আল্লাহ-রসুলের নামে পরিচালিত চরম সুবিধাবাদী নীতি মানুষের সামনে চূড়ান্তভাবে উন্মোচিত হবে। তখন তাঁদের মাফ পাওয়ার আর জায়গা থাকবে না। ‘‘কিন্তু উদ্দেশ্য যত মহৎই হোক, কোনো উসিলাতেই, কোনো অজুহাতেই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের দিকে বাংলাদেশকে ঠেলে দেয়া যাবে না। পৃথিবীতে যত রাষ্ট্র আছে তার বেশিরভাগই রাক্ষস-রাষ্ট্র। রাক্ষসের নখদন্ত যত ছেঁটে দেয়া যায় ততই মঙ্গল। একবার এ রাক্ষস তার পূর্ণ চেহারায় হাজির হলে দেশটা আবার পিছিয়ে পড়বে। মারামারি-খুনখারাবি শুরু হলে লাভ হয় দুই পক্ষের অস্ত্রধারীদের। সমাজটা অস্ত্রধারীদের সমাজে পরিণত হয়। এ অবস্থায় সবাই চরমপন্থী হয়ে যেতে থাকে। বিবেকের স্বর আর শোনা যায় না। নিজের বন্ধুদের ভয়েই সত্য কথা বলতে মানুষ পিছপা হয়। এ অবস্থাতেই বিকশিত হয় অন্ধ-বিশ্বাস আর অন্ধ-অবিশ্বাস।’’ এখন যুদ্ধাপরাধীদের শান্তিপূর্ণ বিচারের স্বার্থেই খুনোখুনি না বাড়িয়ে ‘‘সরকারের উচিত জামায়াতকে বাদ দিয়ে বাকি সব দলকে নিয়ে ‘জাতীয় সঙ্কট মোকাবেলা কমিটি’ গঠন করে এ মুহূর্তে আন্তরিক সংলাপে বসা।’’
যত যা-ই বলি না কেন, বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল বলে চালানো যাবে না। মনে রাখতে হবে, ইতিহাস এবং চরিত্রের দিক থেকে বিএনপি এবং জামায়াত কখনোই এক নয়। ক্ষমতার সুবিধার্থে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ উভয়ই জামায়াতকে আদর করে পাশে বসিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বিএনপিকে ‘জামায়াত’ বলে আখ্যায়িত করাটা ভয়ঙ্কর আত্মঘাতী লাইন। এই লাইন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, দেশকে চরম অশান্তির জাহান্নামে পরিণত করবে, তৃতীয় শক্তি আর পরাশক্তির হাঙ্গর-কুমিরকে খাল কেটে ডেকে আনবে। সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে এ কথাই ঠিক যে: ‘‘রাজনীতি মানেই ক্ষমতায় যাওয়ার এবং অনন্তকাল টিকে থাকার খেলা। যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে ক্ষমতায় যাওয়ার/থাকার সমীকরণই এখনকার সব অনাচারের উৎস।’’ [এই প্যারার এবং এর আগের প্যারায় উদ্ধৃত কথাগুলো দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার রিপোর্টারের প্রশ্নের উত্তরে লিখিতভাবে পাঠানো আমার বক্তব্য। যায়যায়দিনের সেই রিপোর্ট: সাখাওয়াত হোসেন, ‘দেশের অনিশ্চিত যাত্রা: সামনে অন্ধকার সিঁড়ি: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তছনছ চারদিকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা’, দৈনিক যায়যায়দিন, শনিবার, মার্চ ০২, ২০১৩।]
সত্য যে, বিএনপির সীমাবদ্ধতার শেষ নাই। কিন্তু কেইবা ধোয়া তুলসি পাতা রাজনীতিতে? ‘বাম’দের একটা অংশ কি এরশাদী সামরিক স্বৈরাচারের আমলে ১৫-দল ভেঙে বিএনপির সাথে মিলে পাঁচ-দল-সাত-দল খেলা খেলে নি? তাই বলে কি আজকের মহাজোট-মন্ত্রীসভায় তাঁদেরকে পাশে নেয় নি আওয়ামী লীগ? এই মন্ত্রীসভারই শরিক দল জাসদ কি এই আওয়ামী লীগকে, শেখ মুজিবর রহমানকে উৎখাতের জন্য সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহ সৃষ্টি করে নি। একদা বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নিজে কি নিজামীকে পাশে বসিয়ে সংবাদ-সম্মেলন করেন নি? তাহলে আজকে দেশের স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থে, শান্তি-স্বস্তির স্বার্থে, সর্বোপরি যুদ্ধাপরাধের শান্তিপূর্ণ বিচারের স্বার্থে বিএনপির সাথে বসতে সরকারের সমস্যা কোথায়? একাত্তরের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবও কি ইয়াহিয়ার মতো জেনারেলের সাথে সংলাপে বসেন নি?
আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রক্রিয়া-প্রণালী নিয়ে বিএনপির উদ্বেগ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আওয়ামী লীগ অনতিবিলম্বে বিএনপির সাথে আন্তরিকভাবে আলোচনায় বসুক। এই মুহূর্তের বৃহত্তম সংসদীয় দল হিসেবে তাঁদেরই দায়িত্ব বেশি। এইটুকু দায়িত্ববোধ কি আমরা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এই দলটির কাছ থেকে আশা করতে পারি না? আওয়ামী লীগকে এই সৎ পরামর্শ দেওয়ার মতো কোনো মানুষ কি শেখ হাসিনার আশেপাশে নাই? সকলেই কি বিবেকবর্জিত স্তাবকে পরিণত হয়েছেন? আওয়ামী লীগের উচিত বিএনপির সাথে বসে আগামী নির্বাচন সম্পর্কিত তাঁদের উদ্বেগগুলো নিঃশর্তভাবে দূর করা। বিএনপি আজকে জামায়াতের সাথে যে গেছে, সেটা তো সামনের নির্বাচনকে সামনে রেখেই, নাকি? নির্বাচন-প্রণালী ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ দূর হলে তাঁদের সাথে সার্বিক সমঝোতায় আসা সম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। তাতে করে সব দিক থেকে মঙ্গল।
প্রচুর আলোচনা ও হোমওয়ার্কের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও শিক্ষক অধ্যাপক সাংবাদিক শিল্পী কবি সাহিত্যিক বিচারক সেনাবাহিনী পেশাজীবী ব্যবসায়ী ওলামা মাশায়েখ এবং তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে একটি কার্যকর ‘জাতীয় সংকট মোকাবেলা কমিটি’ গঠন করা গেলে যুদ্ধাপরাধের বিচার কেউ ঠেকাতে পারবে না। মাঝখান থেকে আমরা পাব প্রাণবন্ত, সমঝোতাপূর্ণ একটি পার্লামেন্টের নেতৃত্বে পরিচালিত উন্নততর রাজনৈতিক পরিবেশ। মনে রাখতে হবে আগে মানুষ, তারপর আইন-আদালত-মতাদর্শ।
১৮.৪ ঘণ্টা বাঁধবে কে?
এখন প্রশ্ন, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? চিন্তাবৃদ্ধ দলীয় বুদ্ধিজীবীরা কোটারি স্বার্থ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন বলে মনে হয় না। ভরসা সুতরাং সেই তরুণরাই। তরুণরাই আমরা সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বে সামরিক এরশাদশাহীর পতনের পর দুই নেত্রীকে রীতিমতো চাপ প্রয়োগ করে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে মেনে নিতে বাধ্য করেছিলাম। সেই সময় দুই নেত্রীর সমঝোতাতেই ‘রাষ্ট্রপতি সিস্টেম’ থেকে আজ আমরা ‘সংসদীয় সিস্টেমে’। দেশের ক্রান্তিকালে আজ দুই নেত্রীর সমঝোতা অসম্ভব হবে কেন? তরুণ বুদ্ধিজীবী লেখক শিক্ষক সাংবাদিক শিল্পী কবি সকলে মিলে চলুন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সকল দলের কাছে যাই। কারো জন্য অপেক্ষায় বসে থাকার সময় আর নাই। আমাদের বিড়ালের গলায় আমাদেরকেই ঘণ্টা বাঁধতে হবে।
রচনা: ৩রা মার্চ ২০১৩
প্রকাশ: দৈনিক সোনার দেশ, রাজশাহী ৯ই মার্চ ২০১৩
Schema and Logo: Salim Reza Newton
Home Pic: Childhood alphabet of Lalon Susmita Meera on wall
Developed by Fecund IT SolutioNs, Powered by UniqueIT