ঘুম ভেঙে তুমি ডুবে-যাওয়া নদী— বালিয়াপুকুরে একা।
ঘুম ভেঙে তুমি ডিমের নিহত কুসুমের মতো চাঁদ—
ছলাৎছলের গুঁড়োগুঁড়ো কণা বাবলার কানে দুল;
একা-বালুচর শিখে গেছে তার একলা বাসায় থাকা।
ঘুম ভেঙে তুমি জোয়ারের নোনা—চাঁদ-লাগা দুই চোখে
বিদ্ধ দৃষ্টি, জলাবদ্ধতা—জল দেখছে না কেউ;
ঘুম ভেঙে তুমি নিরূপায় নাও, আটাশি সালের ঢেউ—
ঘুম-ভাঙা-চোখ বারোটা বছর তেরটা নদীর শোকে।
ঘুম ভেঙে তুমি ভিন্ন দেশের বিন্ন-গাঁওয়ের মোড়।
ঘুম ভেঙে তুমি আদ্যাশক্তি দুর্গা মায়ের পায়ে—
সপ্তম দিনে সাত-সক্কালে মহিষাসুরের বধ;
ঘুম ভেঙে তুমি অরুণাশিস এক রাজনের মতো ভোর।
ঘুম ভেঙে তুমি সাত-পাহাড়ের ছবির শহরে শুয়ে,
শীতের সকাল— তুলি-বুলবুল ইশ্কুলে চলে গেছে;
ঘুম ভেঙে তুমি জিআরি-টোফেল-ভিসা-পাসপোর্টে কাবু—
প্রশান্ত কোনো সাতসমুদ্রে জানাশোনা গেছে ধুয়ে।
ঘুম ভেঙে তুমি এডিটিং-ক্লাসে— ঘুরে দাঁড়িয়েছে সম্পাদকের স্থান,
সাব-এডিটিঙে ফ্যানের শব্দে দিন ভেসে চলে যাচ্ছে;
ঘুম ভেঙে তুমি পরলোকগত উচ্চশিক্ষা, এডিটর-বধ-কাব্য—
আধা-ক্লাসরুমে ছেলেমেয়ে সব শিরোনামহীন হেডলাইনের গান।
ঘুম ভেঙে তুমি সবিতা-শুভ্র কাকিমার চেনা মুখ—
অষ্টমী-রাতে আচমকা হাতে পাঞ্জাবি-পায়জামা;
সারাটা সন্ধ্যা পূজার প্রতিমা, কোথাও যায় না থামা—
ঘুম ভেঙে, তবু, মগজের ভাঁজে বাজারের ফাস্ট-ফুড।
ঘুম ভেঙে তুমি এককোষী কথা, আদিপ্রাণ-অস্তিত্ব;
ঘুম ভেঙে তুমি সাগরের জলে প্রথম বজ্রপাত।
ঘুম ভেঙে তুমি সকালে-বিকালে আরসি-লেমন-কোলা—
ডাবের পানির অশ্রু-লবণে নারকেল-গাছ ধ্বস্ত।
ঘুম ভেঙে তুমি পার্থ-কমল-সুমন-টুটুল-টুলু—
পরমা ভাষার সঙ্কেত মেনে কথা-চালাচালি, সান্ধ্য;
দুপুর-রোদের খোল-করতালে পথকানা-চোখে ধন্দ।
ঘুম-ভাঙা তুমি সকাল থেকেই— তবু, চোখ ঢুলুঢুলু।
ঘুম ভেঙে তুমি অদ্ভুত এক মহা-লুটপাটে সর্ব-শাপের দংশন।
ঘুম ভেঙে তুমি কবিতার ভূঁয়ে সকাল-সকাল নামছ—
জয় গোস্বামী হাত নেড়ে-নেড়ে তোমাকে-আমাকে ডাকছে।
ঘুম ভেঙে তুমি বন্ধু-সকাশে একলা আকাশে গৌরীপুরের জংশন।
ঘুম ভেঙে তুমি বোনাস একটা নবমী তিথির ছল।
ঘুম ভেঙে তুমি গড়-হাওরের অঞ্জলি লহ চায়ে।
ঘুম ভেঙে তুমি, সকলে, সবাই হারানো পুষ্প-প্রাণ—
তোমারও নাকের ফুলটা কি তুমি হারালে, পুকুর-জল?
ঘুম ভেঙে তুমি দশম শ্রেণীর নারদের স্বাদ, সাজনার শাদা ফুল—
ঘুম ভেঙে তুমি মাথার ভেতরে নৌকা-ভাসানো কলার মোচার ছবি;
নরসুন্দার পাশ ঘিরে-ঘিরে শোলাকিয়া-মাঠ, বত্রিশ, গাইটাল—
ঘুম ভেঙে তুমি গৌর-নিতাই; এপার-ওপার নদীর ছাউনি— অসংখ্য পুল।
ঘুম ভেঙে তুমি ‘এক ফালি মেঘ’— এক ফোঁটা গান সুমনের।
ঘুম ভেঙে তুমি কলকাতা-প্রেস—পুলিশ, পাঁঠা ও জনমত—
‘কাঙালপনা’র সবটা শুধুই পাঁচটা বিবির টান!
তবুও সকাল— ঘুম ভেঙে তুমি ‘ভালবাসা ধ্যানমগ্ন তাপস যেন’।
ঘুম ভেঙে তুমি আলো-রিকশায় ভাঙা রাস্তার গান—
চন্দ্রাবতীর স্মৃতি-কথা হয়ে চন্দ্রাবতীরই দিকে;
ঘুম ভেঙে তুমি সোমাহ-আকাশে আশ্বিনা অন্ত্যেষ্টি—
চাঁদের ব্যথায় ডুবুডুবু-ধানে চন্দ্রাবতীর ঘ্রাণ।
ঘুম ভেঙে তুমি প্রাচীর-পাতানো মুমিনুন্নিসা-কলেজ—
গুরুদয়ালের পেছন-দেয়ালে গুরুর নিহত বিদ্যা;
ঘুম ভেঙে তুমি অপর বঙ্গে কল্যাণী-শীত, এডিনবরার কুয়াশা—
সাত দিন পর-পর একবার সূর্যের মুখ বা লেজ।
ঘুম ভেঙে তুমি চোখের কোণায় নেত্রকোণার গল্প শোনাও—
কংস-নদীর তিতাস-ছেলেটা যুদ্ধের নৈঃশব্দ্য;
ঘুম ভেঙে তুমি মধ্যবিত্ত মনের মধ্যে সোমসোমত্ত বাড়ি-গাড়ি-সুখ-সাধ—
ঘুম ভেঙে তুমি প্রাচীন পুকুরে অর্থবিহীন মন-পারানির নাও।
ঘুম ভেঙে তুমি হাপ্পা সমীপে—পরম গোধূলি-আঁচ—
সূর্য-ক্লান্ত, তবু অনন্ত বয়স্ক দুই চোখ
ঘুমিয়ে পড়েছে কবেকার এক উনিশ-একাত্তরে;
হাপ্পা আসলে তেপান্তরের বিলের মধ্যে একলা একটা গাছ—
আলো ছেনে-ছেনে সময় নিজেই বানিয়েছে তার মুখ।
ঘুম ভেঙে তুমি প্রত্নতত্ত্ব, হরপ্পা-পুরাকীর্তি;
ঘুম ভেঙে তুমি পিসিমা কিংবা দিদিমার চোখে কাঁদছ—
হাপ্পা একটা অনস্তিত্ব, অপরিচয়ের সুখ।
ঘুম ভেঙে তুমি বিজয়া দশমী, প্রতিমাবিসর্জন—
ঘুম ভেঙে তুমি কাদামাখা গায়ে ট্রাকের সামনে ভাসছ;
ঘুম ভেঙে তুমি সর্বজনীন মায়ের সামনে হাসছ—
মগজে তোমার ঢাকের কাঠির মহেঞ্জোদারো-গর্জন।
ঘুম ভেঙে তুমি অচেনা শব্দ, পুরোহিত-ধ্বনি, গভীর সান্দ্র মন্দ্র—
ঘুম ভেঙে তুমি কালীমন্দির, শীতল-সটান মেঝে;
ঘুম ভেঙে তুমি দক্ষিণ হাতে হলুদে-রাঙানো সুতো—
মাথার ওপরে ‘শান্তির জল’ অপরূপ সেই গন্ধ।
ঘুম ভেঙে তুমি একলা শহর, চপল-রাজীব-অনুপম—
ঘুম ভেঙে তুমি বিষাদ-যাতনা-বেদনা-গোপন-বন্ধন;
ঘুম ভেঙে তুমি তবু আর বার চন্দ্রাবতীকে গাইছ—
পুকুরের চাঁদ, পাড়ার আকাশ একলা আলোর সরগম।
ঘুম ভেঙে তুমি বাড়ির মেয়েটা বিদায় নিয়েছে কাল—
এঁদো পুকুরের পরিচিত জলে মাটিগলা রূপখড়;
ঘুম ভেঙে তুমি নিহত বোনের বাঁধানো-ফ্রেমের মুখ—
ঘুম ভেঙে তুমি স্মৃতিদের মাছ, সনাতন শৈবাল।
ঘুম ভেঙে তুমি—তোমার কান্না—সময়ের মতো অদৃশ্য এক জাদু—
ঘুম ভেঙে তুমি দিনে-দিনে-দিনে দ্বিগুন আগুনে সন্তর্পনে নাচছ সর্বক্ষণ;
ঘুম ভেঙে তুমি অনুজের সাথে আলাপে মগ্ন জীবনজগতদর্শন—
অগ্রজ, সে তো বহু কাল আগে যাপিত নিয়মে নিমখুন-গৃহবধূ।
সুলতানপুরে শুকনো হাওরে এমনই থাকবে চাঁদ-চাঁদিনীর বাবু—
ঘুম ভেঙে তুমি সমস্ত কাল ফুলেশ্বরীর পাশ ছুঁয়ে শুয়ে রবে;
ঘুম ভেঙে তুমি নারীর আয়াসে জ্বালবে ঢোলক পুরুষের উৎসবে—
অথচ চন্দ্রাবতীই তোমার ঘুমে-নির্ঘুমে টোটেম এবং ট্যাবু।