English | বাংলা
Logo
 

 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উঠে যাক

সরন-প্রতিসরণ, ১৩-০৭-২০১৭

 


আরাফাতের চোখ: হামলার আগে এবং পরে

 

আজকে আমরা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সমস্ত শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী ডিপার্টমেন্টের কাজ স্থগিত রেখে, ক্লাস থামিয়ে রেখে, এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। আমরা বিপদে পড়েছি। এবং সেই বিপদ আমাদের ব্যক্তিগত না। সেই বিপদ আমাদের শুধু বিভাগগতও না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়েরও বিপদ। এটা সাংবাদিকতা নামক একটা পেশার জন্যেও বিপদ। এটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা ব্যক্তি হিসেবে পড়াশোনা করতে পারবেন কিনা, চলাফেরা করতে পারবেন কিনা, নিরাপদে থাকতে পারবেন কিনা — সেই সমস্ত দিক থেকেও প্রত্যেকটা ব্যক্তি-শিক্ষার্থীর জন্যে বিপদ। এই রকম বিপদে পড়ে আমরা দাঁড়িয়েছি। দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের একজন শিক্ষার্থী যেমনটা বললেন, আমরা এরকম করে দাঁড়াতে চাই না। এবং আমরা পরিষ্কার বলতে চাই যে, এই সমস্ত বালা-মুসিবত-বিপদ খুব বেশি আমাদেরকে ঘায়েল করতে পারবে বলেও আমরা মনে করি না।

 

বিচার চাই তিন তরফে

আমরা কতকগুলো জিনিস খুব পরিষ্কার করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে, বাংলাদেশকে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে, জানাতে চাই। সেটা হলো: আমাদের শিক্ষার্থী আরাফাত — সম্পূর্ণ নির্দোষ একজন মানুষ — যিনি সাংবাদিক হিসেবে তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাঁকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে, দিনের বেলায়, সবার সামনে, বিশ্রীভাবে মারপিট করা হয়েছে। খুব বাজেভাবে তাঁর ওপরে হামলা করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ— তিনি তাঁর পেশাগত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করছিলেন। আমরা এই হামলা যাঁরা করেছেন তাঁদের বিচার চাই। শাস্তি চাই।

শাস্তি চাই বাংলাদেশের প্রচলিত আইন, দণ্ডবিধির কাছ থেকে। শাস্তি চাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। শাস্তি চাই যে-ছাত্র-সংগঠনের নাম ব্যবহার করলে পরে তার কর্মীদের মনের মধ্যে এত বড় ক্ষমতা জাগ্রত হয় যে, তাঁরা প্রায় যা খুশি তাই করতে পারার কথা ভাবতে পারেন, সেই সংগঠনের কাছ থেকেও।

ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তাঁরা বলেছেন, একটা ‘বিচার’ করা হয়েছে, দু-জন ছাত্রকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু আরাফাত নিজে তাঁর ওপরে যাঁরা হামলা করেছেন বলে সুনির্দিষ্ট করে নাম উল্লেখ করেছেন, সেই কর্মীদের বা নেতাদের বা ছাত্রলীগের সেই সদস্যদের বিরুদ্ধে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখি নি। উপরন্তু, আমরা দুঃখজনকভাবে দেখেছি, ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি এটা নিয়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। যেটুকু ব্যবস্থা দুই জনের বিরুদ্ধে নেওয়া হলো সেটাও কেন্দ্রীয় সংগঠনের পক্ষ থেকে নেয়া সিদ্ধান্ত।

উপরন্তু, আমরা খুব দুঃখজনকভাবে আমাদের রাজশাহীর স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদ-মাধ্যমের রিপোর্ট পড়েছি। সেখানে রিপোর্টগুলোতে এসেছে যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা কখনো বলেছেন: না, আমাদের ছেলেমেয়েরা এগুলো করে নি, আমাদের কর্মীরা এগুলো করে নি; কখনো বলেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাস ভাঙচুর করেছে; কখনো বলেছেন সাধারণ পোশাকের পুলিশ আরাফাতকে মারপিট করেছে। এই সমস্ত আন্দাজি কথা থেকে আমরা দুঃখজনকভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য যে, স্থানীয় ছাত্রলীগের, [মানে] রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের, সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের দিক থেকে হয় প্রশ্রয়, না হয় উস্কানি, না হয় আস্কারা— এগুলো কোনো না কোনোভাবে এখানে আছে। সেটা আমাদের জন্য খুব দুঃখজনক।

 

সমস্যাটা শুধু ছাত্রলীগের না

এখানে সমস্যাটা ছাত্রলীগের শুধুমাত্র না। আমি একটু পরিষ্কার করে বলতে চাই। আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখেছি যে, সব সময়ে বড় বড় রাজনৈতিক দল, যাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চান, ক্ষমতা কুক্ষীগত করে রাখতে চান, এই রকম সমস্ত রাজনৈতিক রাজনৈতিক দলই যে-সমস্ত অস্ত্র এবং পদ্ধতি ব্যবহার করেন, ক্ষমতার জন্য, তার মধ্যে একটা হলো, তাঁদের নিজের নিজের রাজনৈতিক দলের ছাত্রশাখাগুলোকে তাঁরা ব্যবহার করেন। ছোট ছোট অল্পবয়েসী বাচ্চাকে, অল্পবয়েসী ছেলেকে, তাঁরা বলতে গেলে ব্যবহার করেন। ঠাণ্ডা মাথায়। সিদ্ধান্ত নিয়ে। এবং এই সমস্ত ব্যবহারবিধির মধ্যে একটা প্রধান ব্যবহারবিধি হলো ক্যাম্পাসগুলোকে দখল করা। ক্যাম্পাসগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এটা ছাত্রলীগকে দিয়ে করানো হয়েছে; আওয়ামী লীগ করাচ্ছে, করিয়েছে। ছাত্রদলকে দিয়ে করানো হয়েছে; বিএনপি করিয়েছে। ছাত্র শিবিরকে দিয়ে করানো হয়েছে; করিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’ ইত্যাদি নামের ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে জাতীয় পার্টি, জেনারেল এরশাদ, সামরিক শাসন সেগুলো করিয়েছে। পাকিস্তান আমলে ‘এনএসএফ’-এর মতো ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে আইয়ুব খান করিয়েছে। এগুলো চিরকাল করানো হয়েছে।

আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অনুরোধ করতে চাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য হিসেবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যে— এই সমস্ত পদ্ধতি ভালো না। কারও জন্য ভালো না। আজকে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যদি কোনো শাস্তি হয় সেগুলো ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েদের উপর দিয়েই যাবে। কিন্তু যাঁরা ব্যবহার করছেন তাঁরা রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য, খুবই ক্ষতিকর কাজ করছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে এই রকম ক্ষতিকর কাজ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপকার হবে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস যেটা আছে — একেবারে সর্বজনসম্মত ইতিহাস — সেই ইতিহাস বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জেগে ওঠার ইতিহাস। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের উপযুক্ত কর্তব্য পালনের ইতিহাস। এই সমস্ত ইতিহাস বাদ দিয়ে আপনি আওয়ামী লীগ, বিএনপির ইতিহাস খুঁজে পাবেন না।

 

আত্মর্যাদার প্রশ্ন

এগুলো হলো ওভারঅল কথা— বৃহত্তর পর্যায়ে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট পর্যায়ে কতকগুলো কথা আছে। আমাদের ছেলেমেয়েদের উপরে, আমাদের নিজেদের উপরে, একেবারে প্রত্যক্ষ দৈহিক হামলা আসলে আমাদেরকে আমাদের আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য আমরা যা যা করতে পারি তাই তাই করার জন্য সম্ভাব্য পদ্ধতি-উপায়গুলো ভেবে দেখতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমাদের অন্য কোনো উপায় থাকছে না। থাকবে না। আমাদের যদি মান-ইজ্জত না থাকে — মানুষের বাচ্চা হিসেবে — যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা আমাদের আত্মমর্যাদাটুকু বাঁচাতে না পারি, আমরা যদি আমাদের শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা বাঁচাতে না পারি, তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয় রেখে কী লাভ! যাঁরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে এতই মুশকিল মনে করেন তাঁরা পরিষ্কার করে দাবি তুলেন না কেন— বাংলাদেশ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় উঠে যাক! বাংলাদেশে শুধু আওয়ামী লীগ থাক! বাংলাদেশে শুধু ছাত্রলীগ থাক! বাংলাদেশে শুধু সেনাবাহিনী থাক! শুধু র‌্যাব থাক! শুধু রাজনৈতিক দল থাক! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নাই। বাংলাদেশের এই যে সরকার আছেন, তাঁদের নিজেদের সংসদ আছে। সেই সংসদে আইন পাশ করুন না!

 

ছাত্রলীগের সমালোচনা করা যাবে না?

ছাত্রলীগের তরফ থেকে একটা অদ্ভুত থিওরি (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকেও, এবং সারা বাংলাদেশেও) সাধারণভাবে, বারবার করে বলা হচ্ছে। কী? ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা যাবে না। ছাত্রলীগের ভেতরে নাকি অনেক ‘খারাপ’ ‘খারাপ’ (তাঁদের ভাষায়) ছেলেমেয়েরা আছেন, তাঁদের সমালোচনা করতে হবে। কেন? ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা করা যাবে না এমন কোনো ‘ইনডেমনিটি আইন’ পাশ হয়েছে নাকি?

বাংলাদেশে যে-কারোরই সমালোচনা করা যাবে। গণযোগাযোগ বিভাগের সমালোচনা করা যাবে। সেলিম রেজা নিউটনের সমালোচনা করা যাবে। আরাফাত রহমানের সমালোচনা করা যাবে। সাংবাদিকতার সমালোচনা করা যাবে— আমরা করিও। শেখ হাসিনার সমালোচনা করাও যাবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমালোচনা করা যাবে। অবশ্যই সবাইকে নিয়েই সমালোচনা করা যাবে।

এতো পাতলা চামড়া হলে রাজনীতি করা যাবে না। আর এমন স্বেচ্ছাচারী হুকুমদারি ... যদি আমি হুকুম জারি করি, অমুক সংগঠনের নামে আপনি সমালোচনা করতে পারবেন না, তাহলে হবে না। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ আমরা। আমাদের নিজেদের অনেক দোষত্রুটি আছে। বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের দোষত্রুটি আছে। আওয়ামী লীগের দোষত্রুটি আছে। ছাত্রলীগের দোষত্রুটি আছে। অন্যান্য দলের আছে। কেউই দোষত্রুটির ঊর্ধে না।

আমরা কারও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে খারিজ করতে চাই না। কিন্তু বিরাট কোনো ‘গৌরবোজ্জল ইতিহাস’ যদি আমাদের ব্যক্তিগত আত্মমর্যাদার জন্য, পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে টিকে থাকার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেই ‘গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস’ আমাদের ঘাড়ে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো খুব কঠিন। এই কথাটা ছাত্রলীগকে বুঝতে হবে। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে। অন্যান্য দলকে বুঝতে হবে। বাংলাদেশকে বুঝতে হবে।

আমরা নিজেরা, আমি নিজে, আমাদের বিভাগ— আমরা বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকতার গুরুতর সমালোচনা করেছি। আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনেক খামতির কথা বলেছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনেক ধরনের সংস্কার দরকার। অনেক পরিবর্তন দরকার।

আমরা এক কথায় বলতে চাই। আমরা ছাত্রলীগের নেতাদের কাছ থেকে ... ওঁরা আমাদেরই ছোট ভাই, ওঁরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই পরিবারের সদস্য। তাঁরা নিজেদের যেন সেইভাবে বিবেচনা করেন। তাঁরা যেন নিজেরা মানুষ হিসেবে কতকগুলো জিনিস ভাবেন। আমাদের দিক থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে কোনো প্রতিপক্ষতা নাই। আমাদের দিক থেকে কারো সঙ্গেই কোনো প্রতিপক্ষতা নাই।

আমরা এখানে জ্ঞানচর্চার জন্য, সাংবাদিকতার জন্য দাঁড়িয়েছি। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে সাংবাদিকতা করা শেখাই। এবং সেই সাংবাদিকতার শিক্ষা নিয়ে ... তাঁরা যখন আমাদের বাড়ির উঠানে (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে) সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে সাংবাদিকতা করেন এবং তার জন্য তাঁর ওপরে হামলার শিকার হয়, তখন আমরা যারা সাংবাদিকতা শিখিয়েছি, আমরা ‘অপরাধী’ হয়ে যাই। এটা বুঝতে হবে।

 

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজ

সর্বোপরি, আমি আকাশ-বাতাসকে শুধুমাত্র দোষারোপ করলে হবে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে, আমার জানা মতে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকেরা অভিযোগ করেছেন। সেই অভিযোগের ব্যবস্থা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে নিতে হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এইক্ষেত্রে উদাসীন থাকতে পারেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। তক্ষণেও যে করা হয় নি সেটা একটা আশ্চর্য ঘটনা। এবং নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি করলে হবে না। আমরা পরিষ্কারভাবে, সুর্নির্দিষ্টভাবে আমাদের বাড়ির মধ্যে — রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের উঠানের মধ্যে — যে ঘটনা ঘটেছে, সে ঘটনা কারা ঘটিয়েছে সেটা বের করা হোক সেটা চাই। এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাজ।

 

আমরা ডক্টর জোহাকে চাই : এই প্রক্টরিয়াল বডি চাই না

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, আমাদের প্রক্টরিয়াল বডি, সারাদিন আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে চা খাওয়া যাবে না, আড্ডা মারা যাবে না, গান করা যাবে না, দল বেঁধে হাঁটা যাবে না, ড্যাশ করা যাবে না, ড্যাশ করা যাবে না, চায়ের দোকান খোলা রাখা যাবে না, গেট দিয়ে সকালে ঢোকা যাবে না, গেট দিয়ে বিকালে ঢোকা যাবে না, পরিচয়পত্র এখন দেখাতে হবে, তখন দেখাতে হবে ... এ সমস্ত হয়রানি করবেন ... বিরাট প্রক্টরিয়াল বডি নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে একটা ‘পুলিশ ক্যাম্পে’ পরিণত করে আপনারা নানান ধরনের পাঁয়তারা করবেন, আর আপনার ছেলেমেয়েদের উপর দৈহিকভাবে হামলা হবে, প্রকাশ্যে দিনের বেলায়, কিন্তু আপনারা একটা তদন্ত কমিটি করবেন না, বিচারের ব্যবস্থা করবেন না— এই প্রক্টরিয়াল বডি আমি চাই না। এটা আমরা চাই না।

আমরা ডক্টর জোহাকে চাই। ডক্টর জোহার আত্মা আমাদের ঘাড়ের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই আত্মা আমাদের শান্তি দিচ্ছে না। দিবে না। ডক্টর জোহা আজকের সেলিম রেজা নিউটনের চাইতে, আমাদের এখানকার অনেক সহকর্মীর চাইতে অনেক অল্প বয়েসে যে কাজ করেছেন, সেই কাজ থেকে আমাদের পিছিয়ে আসার কোনো উপায় নাই। কাজেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

পুলিশ চলে অথোরিটির কথায়

আর একটা কথা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারে পুলিশ কতটুকু মুভ করে এবং করে না সেটা কিন্তু নির্ভর করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অথোরিটির মনোভঙ্গির উপরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অথোরিটির কথায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতরে পুলিশ চলে। এইটুকু বলা যায়। এইটুকু আমরা জানি। সুতরাং পুলিশ যদি ব্যবস্থা না নেয় এইক্ষেত্রে, তাহলে আমাদের এটাও বুঝতে হবে যে, পুলিশের গাফেলতি আছে। সেই সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ থেকে পুলিশ ভিন্ন কোনো ‘সিগনাল’ পাচ্ছে কিনা সেইটা আমাদেরকে পরিষ্কার করে বলতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।

 

এটা কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না

আমরা আরাফাতকে বলতে চাই, আমরা আমাদের সাংবাদিক ছেলেমেয়েদেরকে বলতে চাই (তাঁরা যে-ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েই হোন না কেন) যে, আমরা সবাই একসঙ্গে আছি। বিপদ-আপদ যা আসবে, আমাদের সবার উপর দিয়েই আসবে।

এটা কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না। এটা কোনো দল পাকানোর ইস্যু না। আমাদের এখানকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বহু ছেলেমেয়ে বাংলাদেশ সরকারের সমর্থক। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক। আরাফাত নিজে, তাঁর পরিবার, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত। শুধু সেই কারণেই তাঁর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে তা না। কিন্তু এগুলো বুঝতে হবে। আমরা যদি এগুলো না বুঝি, তাহলে কানার মতো রাজনীতি করলে পরে আমাদের অসুবিধা হবে।

 

শিবিরের বিরুদ্ধে রক্ত দিয়েছে অনেকে

যাঁরা মনে করেন যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিবিরকে ‘তাড়িয়েছে’ একটা নির্দিষ্ট ছাত্র সংগঠন, আমি পরিষ্কার বলতে চাই, তাঁদের থেকে আমার বয়েস অনেক বেশি। এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে ২৪ বছর ধরে দেখছি। এখানে শিবিরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে, নিগৃহীত হয়েছে, হাতুড়ি-পেটা হয়েছে ... ড্রিল দিয়ে দেহে ছিদ্র করা হয়েছে, হল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ... হাজার হাজার ছেলেমেয়ে। প্রচুর শিক্ষক আমরা শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছি।

 

বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর জন্য জেল খেটেছি আমরা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলাদেশে, এমন অনেক দুর্দিন গেছে, যে-দুর্দিনে অনেক শিক্ষককে দাঁড়াতে হয়েছে। কোনো ছাত্র সংগঠনকে আমরা খুঁজে পাই নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাত্রলীগ-শূন্য অবস্থায় বছরের পর বছর থেকেছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমরা অনেক মানুষ এটা দেখেছি। আমরা জানি সেগুলো।

যখন খোদ শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট সরকার ওয়ান-ইলেভেনের সময় বন্দি করে রেখেছিল, আমরা কোনো ছাত্রলীগকে খুঁজে পাই নি সেই বন্দিত্বের বিরুদ্ধে একটা মিছিল করতে। আমরা বাংলাদেশের ওয়ান-ইলেভেনের সামরিক শাসনকে রুখে দাঁড়িয়েছি — বাংলাদেশের শিক্ষকরা— সবার আগে। এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও— সবার আগে। এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকরা— সবার আগে। সেইদিন আমরা ছাত্রলীগকে খুঁজে পাই নাই। সেইদিন আমাদের মিছিলের পেছনে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারিকে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’র পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়ে মিছিল করতে হয়েছে।

আমরা জেল খেটেছি। আমরা অনেক রকমের পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। শুধুমাত্র শেখ হাসিনার জন্য না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর জন্য। আজকে যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে হামলা আসে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ দাঁড়াবে। বাংলাদেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দাঁড়াবেন। আমি নিশ্চিত করেই বলছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক দাঁড়াবেন। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যাপার না। এটা কোনো দল না। এটা কোনো রাজনীতি না। এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর প্রশ্ন। এটা সাংবাদিকতাকে বাঁচানোর জন্য।

 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় নেবে ছাত্রলীগ

আমি আশা করব, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কর্তৃপক্ষ, কেন্দ্রীয় কমিটি, রাজশাহীর স্থানীয় কমিটি বিষয়গুলোকে ‘মানুষের বাচ্চা’ হিসেবে বিবেচনা করবেন। মানবীয় অনুভূতি হিসেবে, মানবীয় অনুভূতি থেকে দেখবেন। এবং তাঁরা নিজেরা আরও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সুনির্দিষ্টভাবে যাঁরা যাঁরা সাংবাদিকদেরকে এখনও হুমকি দিচ্ছে — ফেসবুকে, পার্সোনালি, প্রকাশ্যে, গোপনে — এবং যাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে হামলা চালিয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে ছাত্রলীগ আরও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ছাত্রলীগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করবে যেন কর্তৃপক্ষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যূনতম শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পুলিশ কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করবে। কেন করবে না? বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বাংলাদেশের দায় নেবে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় নেবে। কেন ছাত্রলীগ তার ‘হাতেগোনা’, (তাঁদের ভাষায়) ‘কয়েকজন’, (তাঁদের ভাষায়) ‘বিপথগামী’ শিক্ষার্থীর পক্ষে দাঁড়াবে? সেটা প্রকাশ্যে হোক আর অপ্রকাশ্যে হোক? সেটা তো আমাদের মাথায় আসে না!

 

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মর্যাদা

আপনাদের সবাইকে আমি অনেক শুকরিয়া জানাচ্ছি। আরেকটা কথা বলি। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ নিয়ে [ ... ] হুটহাট করে আবোলতাবোল স্টেটাস যাঁরা ফেইসবুকে দিচ্ছেন তাঁদের বলি। [ ... ] গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অনেক ত্রুটি আছে। অনেক সমালোচনা আছে। অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের সব শিক্ষক আমরা একই সমানভাবে সব কর্তব্য করতে পারি না। কিন্তু এই কথা পরিষ্কার বাংলায় মনে রাখবেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ গোটা বাংলাদেশের কয়েক শ ডিপার্টমেন্টের মধ্যে একটা বিশিষ্ট ডিপার্টমেন্ট। সেটা আকাশ থেকে আসে নি। এই বিভাগের মর্যাদা এই বিভাগের সদস্য হিসেবে সবাই যেন ‘ওউন’ করেন। দুই-একজন আবোল-তাবোল কথা ফেসবুকে লিখছেন। তাঁদের ব্যাপারে আমি আপনাদের কাছেই অনুরোধ করছি: আপনারা যাঁরা আজকের শিক্ষার্থী এবং আপনারা যাঁরা আমাদের বিগত শিক্ষার্থী, আপনারা দয়া করে ওঁদেরকে বুঝাবেন। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে। তা যদি না থাকে— ব্যক্তিগত অসুখ, ব্যক্তিগত চুলকানি, অসাফল্য, ব্যক্তিগত সমস্যাজনিত অশান্তি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ঘাড়ের উপরে চাপাবেন না দয়া করে।

 

আমাদেরকে আরো অনেকবার দাঁড়াতে হতে পারে

আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ধন্যবাদ জানানোর কিছু নাই আসলে। আমরা সবাই মিলে দাঁড়াতে পেরেছি, এইটা আমাদের জন্য শান্তির। এইটা আমাদের জন্য স্বস্তির। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রত্যেকটা শিক্ষক, আজকের সমস্ত শিক্ষার্থী, আরাফাতের বন্ধুরা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকেরা, আরাফাতের জেলা ঝিনাইদহের শিক্ষার্থীরা— সবাই মিলে আমরা আজকে এটা করতে পেরেছি।

আমাদেরকে আরো অনেকবার দাঁড়াতে হতে পারে। আমরা দাঁড়াব। আমরা যেন দাঁড়াই। এটা কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না। এটা আমাদের আত্মমর্যাদার ইস্যু। আপনাদের সবাইকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

এই তো কথা আজকের মতো। #

 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টারের সাংবাদিক আরাফাত রাহমানের ওপর হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে বিভাগ কর্তৃক ১৩ই জুলাই ২০১৭ তারিখে বিভাগের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটনের দেয়া বক্তব্যের অডিও-অনুলিপি। অডিওর একেবারের শেষের দিকে কয়েকটা বাক্য এখানে অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে। সেটুকু ত্রিবিন্দু [ ... ] দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অনুলিপিটি সেলিম রেজা নিউটন নিজে সম্পাদনা করেছেন। শিরোনাম এবং উপশিরোনামগুলো তাঁরই সংযোজিত। এই রচনাটির সাথে কতকগুলো পাদটীকা যুক্ত করার কাজ বাকি আছে। পরে এই সাইটে সেটা যুক্ত করা হবে।

শ্রুতিলিখন : শিহাবুল ইসলাম

 
 
 
 
 
Logo