English | বাংলা
Logo
 

 

নোম চমস্কি: ভবিষ্যতের সরকার

মাওরুম, ঢাকা, ০৮-০৫-২০০৯

 


ভাষান্তর: সেলিম রেজা নিউটন


ঘোষক: যে শ্রুতি-সেমিনারটি আপনারা শুনতে যাচ্ছেন সেটি শব্দযন্ত্রে ধারণ করা হয়েছিল নিউ ইয়র্কের যুবক-যুবতীদের হিব্রু সমিতির কবিতা-কেন্দ্রে, ১৯৭০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি। এই অনুষ্ঠান হাজির করছে নোম চমস্কিকে। তিনি বলবেন ‘‘ভবিষ্যতের সরকার’’ নিয়ে। বলছেন নোম চমস্কি ...


একটি অগ্রসর শিল্পায়িত সমাজে রাষ্ট্রের ভূমিকা সংক্রান্ত মোটামুটিভাবে আদর্শ চারটা অবস্থানকে আলোচনার কর্মকাঠামো হিসেবে দাঁড় করিয়ে নেওয়াটা আমার মনে হয় কাজের হবে। এই অবস্থানগুলোকে আমি (১) ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী, (২) মুক্তিপরায়ন সমাজতান্ত্রিক, (৩) রাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক, এবং (৪) রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী অবস্থান নামে ডাকতে চাই এবং একটা একটা করে আমি এগুলো বিবেচনা করে দেখতে চাই।

আর, আমার নিজের অবস্থানটা আমি আগেই পরিস্কার করে দিতে চাই, যেন আমি কী বলছি তা আপনারা মুল্যায়ন ও বিচার করতে পারেন। মুক্তিপরায়ন সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বলতে আমি বাম-অভিমুখীন মার্কসবাদ থেকে শুরু করে নৈরাজ্যবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত চিন্তাধারার পরিসরটিকে বোঝাতে চাই। আমার মনে হয়, এই ধ্যানধারণাগুলো মূলগতভাবে সঠিক এবং অগ্রসর শিল্পায়িত সমাজের যুগে এগুলোই ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের উপযুক্ত ও স্বাভাবিক সম্প্রসারণ। উল্টোদিকে, আমার মনে হয়, শিল্পায়িত দেশগুলোতে তথা শিল্পায়িত সমাজসমূহে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের মতাদর্শ (অর্থাৎ যেটা বলশেভিকতন্ত্রে পরিণত হয়েছে), রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের মতাদর্শ, আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র-এগুলো নিঃসন্দেহে আধিপত্যশীল; কিন্তু আমার বিশ্বাস, সামাজিক তত্ত্ব হিসেবে এগুলো পশ্চাদমুখী এবং অত্যন্ত অপর্যাপ্ত। এবং আমার বিশ্বাস, আধুনিক শিল্পায়িত সমাজের সাথে এইসব সামাজিক কাঠামোর এক প্রকার অনুপযুক্ততা এবং সামঞ্জস্যহীনতা থেকেই আমাদের সত্যিকারের মৌলিক সমস্যাগুলোর একটা বিরাট অংশের উদ্ভব ঘটে থাকে।

তো, এখন তাহলে এই চারটা আলোচ্য অবস্থান একটা একটা করে বিবেচনা করে দেখা যাক। আরম্ভ করব ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।



ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ


ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সবচেয়ে পরিসীমিত ও ন্যূনতম উপায়- আঙ্গিকগুলো ছাড়া অন্য সকল প্রকার হস্তক্ষেপের বিরোধিতার ঘোষণা দেয় ধ্রুপদীউদার-নীতিবাদ। এ হলো তার প্রধান ভাবধারা। আচ্ছা, এই সিদ্ধান্তটি পরিপূর্ণভাবে পরিচিত ঠিকই, কিন্তু যে যুক্তি-পরম্পরা এই সিদ্ধান্তটিতে পৌঁছানোর উপায় হিসেবে কাজ করে, সেটি অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত এবং আমার মনে হয়, খোদ সিদ্ধান্তটির চেয়ে সেটি অনেকখানি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এই অবস্থানের একেবারে গোড়ার দিকের এবং সবচাইতে দীপ্তিময় ব্যাখ্যাগুলোর একটা হচ্ছে ভিলহেল্ম্ ভন হামবোল্টের রাষ্ট্রকর্মের সীমা । এটা লেখা হয়েছিল ১৭৯২ সালে। কিন্তু পরবর্তী ৬০/৭০ বছর ধরে এটা অপ্রকাশিতই ছিল। তাঁর মতে:

 

রাষ্ট্রের ঝোঁক হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে উপেক্ষা করে তাকে রাষ্ট্রের একনায়কসুলভ উদ্দেশ্য সাধনের যন্ত্রে পরিণত করা, এবং মৌলিক স্বভাবের দিক থেকে মানুষ যেহেতু স্বাধীন, অনুসন্ধানশীল এবং নিজেকে নিখুঁত করে-তুলতে-থাকা একটি সত্তা, সুতরাং বোঝা-ই যায়, রাষ্ট্র হচ্ছে গভীরভাবে মানবিকতা-বিরোধী একটি প্রতিষ্ঠান।


অর্থাৎ, সমৃদ্ধতম বৈচিত্র্য সহযোগে মানবীয় সুপ্তশক্তির পূর্ণাঙ্গ ঐকতানমূলক বিকাশের সাথে রাষ্ট্রের কার্যকলাপ ও অস্তিত্ব শেষ পর্যন্ত বেমানান। সুতরাং, হামবোল্ট-এবং পরের শতকে মার্কস, বাকুনিন, মিল এবং আরও অনেকে-মানুষের প্রকৃত অভীষ্ট হিসেবে যাকে বিবেচনা করেছেন তার সাথেও রাষ্ট্রের কার্যকলাপ ও অস্তিত্ব মানানসই নয়। এবং আমার মনে হয় এটা একটা যথার্থ বিবরণ।

আধুনিক রক্ষণশীলগণ যে নিজেদেরকে ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের সরাসরি-বংশধর বলে ভাবতে চান-সেটা এই অর্থে। কিন্তু আমার মনে হয়, শুধুমাত্র চূড়ান্ত রকম ভাসাভাসা একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এমন ভাবনায় অটল থাকা যেতে পারে। ধ্রুপদী মুক্তিপরায়ন চিন্তনের মৌলিক ভাবধারাগুলো অপেক্ষাকৃত সতর্কভাবে অধ্যয়নের মাধ্যমে চাইলে কেউ সেটা দেখতে পারেন। এই চিন্তনের প্রকাশ, আমার মতে, সবচেয়ে প্রগাঢ়ভাবে ঘটেছে হামবোল্টের রচনায়।

আমার মনে হয়, এ-সব প্রসঙ্গের যথেষ্ট ব্যাপক সমসাময়িক তাৎপর্য রয়েছে, এবং খানিকটা হয়ত সুপ্রাচীন পুঁথিপত্র পাঠজনিত সংক্ষিপ্ত সফরের মতোই মনে হতে পারে, তবু যদি আপনারা কিছু মনে না করেন, প্রসঙ্গগুলো আমি একটু বিশদ করতে চাই।

রুশোর মতো, বা তাঁর আগে কার্তেসীয়দের মতো, হামবোল্টের অভিমতও এই যে, মানুষের প্রধান ধর্ম তার স্বাধীনতা।

 

অনুসন্ধান করা এবং সৃজন করা-এগুলোই হচ্ছে সেইসব কেন্দ্র, যাদেরকে ঘিরে যাবতীয় মানবীয় কর্মপ্রয়াস কমবেশি প্রত্যক্ষভাবে আবর্তিত হয়।


কিন্তু, আরো একটু এগিয়ে গিয়ে তিনি বলেন,
 

সমস্ত নীতিনৈতিকতাজনিত সংস্কৃতি জন্মলাভ করে একান্তভাবে এবং সরাসরিভাবে আত্মার অন্তর্জীবন থেকে। বাহ্যিক ও বানানো ফন্দিফিকির দিয়ে কখনোই তা উৎপাদন করা যায় না। যেকোনো মানুষের অপরাপর অন্তর্গত সক্ষমতার মতোই, উপলব্ধির অনুশীলনও সাধারণত অর্জিত হয় তাঁর নিজের কর্মতৎপরতা, তাঁর নিজের উদ্ভাবনী শক্তি অথবা অন্যদের আবিষ্কার কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তাঁর নিজের কর্মপদ্ধতির মধ্য দিয়ে।


তো, বোঝাই যাচ্ছে, এই সব ধারণা-অনুমান থেকে একটা শিক্ষা-তত্ত্ব দাঁড় করানো যায় (এবং তিনি তা দাঁড় করান-ও বটে, যদিও সে পথে আমি যাব না), কিন্তু অন্যকিছুও দাঁড় করানো যায়। হামবোল্ট এগিয়ে যান শোষণের তত্ত্ব এবং বিচ্ছিন্ন শ্রমের তত্ত্বের অন্তত আদি-সূত্রগুলো দাঁড় করানোর দিকে, যা-আমার মনে হয়-অনেক তাৎপর্যপূর্ণ দিক দিয়েই গোড়ার দিককার মার্কসের কথা মনে করিয়ে দেয়। স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে উপলব্ধির অনুশীলন সংক্রান্ত যেসব মন্তব্যের উদ্ধৃতি আমি দিলাম, সেগুলো আসলে এভাবে বলেছিলেন হামবোল্ট:
 

যে-জিনিসটা মানুষ নিজে বানায়, সেটাকে সে যতটা নিজের বলে ভাবে, তার তুলনায় যে-জিনিসটার সে মালিক, সেটাকে কখনও ততোটা নিজের বলে ভাবে না। এবং যে-ভোগবিলাসীরা বাগানের ফলমূল বেশুমার উপভোগ করেন, তাঁদের তুলনায় যে-শ্রমিক বাগানটার পরিচর্যা করেন, তিনটি সম্ভবত অনেক বেশি সত্যিকার অর্থে সেটার মালিক। আর যেহেতু খাঁটি মানবীয় কাজ হলো সেইটা, যা আসে অন্তরের তাগিদ থেকে, তাতে করে মনে হয় যেন সকল কৃষক এবং কারুকুশলীকে উন্নীত করে নেওয়া যেত শিল্পী পর্যায়ে, অর্থাৎ এমন মানুষের পর্যায়ে, যাঁরা তাঁদের শ্রমকে ভালোবাসেন শুধু শ্রমেরই খাতিরে, সেই শ্রমের উন্নতি ঘটান নিজস্ব নমনীয় প্রতিভা এবং উদ্ভাবনী দক্ষতার সাহায্যে এবং সেই সূত্রে অনুশীলন করেন নিজেদের মেধার, মর্যাদাবান করে তোলেন নিজেদের চরিত্রকে, আর উল্লসিত ও পরিমার্জিত করে তোলেন নিজেদের আনন্দসুখ। এরকমটা হলে মানবিকতা ঠিক সেই সমস্তজিনিসের জন্যই মর্যাদাসম্পন্ন হয়ে উঠত, যেসব জিনিস এখন প্রায়ই তার মর্যাদাহানি ঘটায়, যদিও জিনিসগুলো নিজেরা সুন্দরই বটে।


হামবোল্ট বলেছিলেন,
 

নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা হচ্ছে সেই অপরিহার্য শর্ত, যাকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিক মানবীয় স্বভাবের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল কর্মপ্রয়াসও কল্যাণকর কোনো প্রভাব উৎপন্ন করতে পারে না। জিনিসটা যা-ই হোক না কেন, সেটা যদি একজন মানুষের স্বাধীন পছন্দ থেকে জন্মলাভ না-করে থাকে, অথবা সেটা যদি শুধু আদেশ-নির্দেশ ও পরিচালনা-নির্দেশনার ফলাফল-মাত্র হয়ে থাকে, তাহলে সেটা তাঁর একান্ত সত্তার ভেতরে প্রবেশ করে না, বরং তাঁর প্রকৃত স্বভাব থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থেকে যায়। তিনি এটা সত্যিকারের মানবীয় কর্মশক্তি সহযোগে সম্পাদন করেন না, সম্পাদন করেন বরং স্রেফ যান্ত্রিক নির্ভুলতা সহযোগে। কিন্তু একজন মানুষ যদি তাঁর নিজের আগ্রহ, কর্মশক্তি ও ক্ষমতা দ্বারা নির্ধারিত উপায়ের বদলে বহিঃস্থ দাবি ও নির্দেশনা মোতাবেক যান্ত্রিক উপায়ে কাজ করেন, তাহলে আমরা তাঁকে বাহবা দিতে পারি বটে, কিন্তু তিনি যা সম্পাদন করেন তাকে আমরা তুচ্ছ জ্ঞান-ই করি।


হামবোল্টের মতে তাহলে, মানুষের জন্মই হয়েছে অনুসন্ধান এবং সৃজনের জন্য, এবং যখন একজন মানুষ বা একটি শিশু তাঁর নিজের স্বাধীন পছন্দ-অপছন্দ অনুসারে অনুসন্ধান বা সৃজনের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি হয়ে ওঠেন, হামবোল্টের নিজের ভাষায়, ‘‘একজন শিল্পী-তিনি তখন আর উৎপাদনের যন্ত্র নন, বা সুপ্রশিক্ষিত একটি তোতাপাখি নন’’। মানুষের স্বভাব সম্পর্কে তাঁর ধারণার নির্যাস এটাই। এবং আমার মনে হয়, এ থেকে অনেক কিছুই বোঝা যায় এবং মার্কসের সঙ্গে, মার্কসের গোড়ার দিককার পান্ডুলিপির সাথে, বিশেষত তাঁর ‘‘শ্রমের বিচ্ছিন্নতা’’ সংক্রান্ত নিচের বিবরণের সাথে তুলনা করলে, তুলনার বিচারে ব্যাপারটা খুবই কৌতূহল-উদ্দীপক হয়ে ওঠে:
 

শ্রমের বিচ্ছিন্নতা ঘটে তখনই, শ্রমিকের কাছে কাজ যখন বাইরে-থেকে-আসা একটা ব্যাপার, যখন কাজ তাঁর স্বভাবের অংশ নয়। এমন যে, তিনি তাঁর কাজের মধ্যে নিজেকে পূর্ণ করে তোলেন না, বরং খারিজ করে দেন নিজেকেই, এবং শারিরীকভাবে তিনি হয়ে পড়েন নিঃশেষিত আর মানসিকভাবে অধঃপতিত। এই বিচ্ছিন্ন শ্রম শ্রমিকদের একটা অংশকে নিক্ষেপ করে আবার সেই বর্বর ধরণের কাজের মধ্যে, আর বাকি অংশকে পরিণত করে মেশিনে। এভাবে মানুষকে তা বঞ্চিত করে তাঁর প্রজাতি-ধর্ম থেকে, স্বাধীন সচেতন কর্মতৎপরতা আর উৎপাদনশীল জীবন থেকে।


মার্কসের সেই সুপরিচিত ও প্রায়শ-উদ্ধৃত রচনার কথাও স্মরণ করে দেখুন, যেখানে সমাজের এমন একটা উচ্চতর রূপের কথা বলা হচ্ছে, শ্রম যেখানে জীবনের একটা উপায় মাত্র নয়, জীবনের সর্বোচ্চ চাওয়াও বটে। এবং বিশেষায়িত শ্রম সম্পর্কে তাঁর উপর্যুপরি সমালোচনার কথাও মনে করে দেখুন। বিশেষায়িত শ্রম
 

শ্রমিকের অঙ্গহানি ঘটিয়ে তাঁকে মানব-সত্তার একটা টুকরা-অংশে পরিণত করে ফেলে, অধঃপতিত ক’রে তাঁকে স্রেফ খুচরা যন্ত্রাংশ বানিয়ে ফেলে; তাঁর কাজকে এমন নিদারুণ যন্ত্রণায় পরিণত করে যে, কাজের আসল অর্থই ধ্বংস হয়ে যায়; আর শ্রম-প্রক্রিয়ার মধ্যেকার বুদ্ধিবৃত্তিক সুপ্ত সম্ভাবনা-গুলোকে তাঁর কাছ থেকে পৃথক করে রাখে ঠিক সেই অনুপাতে, যে-মাত্রা পর্যন্ত বিজ্ঞান একটা স্বাধীন শক্তি হিসেবে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত।


রবার্ট টাকার সঠিকভাবেই জোর দিয়ে বলেছেন যে, একজন বিপ্লবীকে মার্কস যতটা না অতৃপ্ত ভোক্তা হিসেবে দেখেছেন, তার চেয়ে বেশি দেখেছেন হতাশ উৎপাদক হিসেবে। এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের অনেক বেশি র‌্যাডিক্যাল এই পর্যালোচনা প্রায়শই একই ভাষায় প্রবাহিত হয় আলোকায়নের মুক্তিমুখীন চিন্তাধারা থেকেও। এই কারণে আমার মনে হয়, এ-কথা মানতেই হবে যে, নির্যাসের দিক থেকে (অবশ্য যেভাবে তা বিকশিত হয়ে উঠেছিল সেদিক থেকে নয়) ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী ভাবধারা গভীরভাবে পুঁজিবাদবিরোধী। এই ভাবধারাকে যদি আধুনিক শিল্প-পুঁজিবাদের মতাদর্শ হিসেবে কাজ করতে হয় তবে তার এই নির্যাসকে অবশ্যই ধ্বংস করতে হবে।

১৭৮০-র দশকে এবং ১৭৯০-র প্রথম দিকে বসে লেখার সময় হামবোল্টের কোনো ধারণা ছিল না, আধুনিক পুঁজিবাদ কী রূপ ধারণ করবে। ফলে, ধ্রুপদী উদারনীতিবাদের এই চিরায়ত গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করার সমস্যাটির ওপর জোর দিয়েছেন, এবং প্রকাশ্যত তিনি ব্যক্তি-খাতের ক্ষমতার বিপদ নিয়ে চিন্তিত নন। এর কারণ হলো এই যে, তিনি ব্যক্তি-নাগরিকদের অবস্থার আবশ্যিক সমতায় বিশ্বাস করেন এবং তার পক্ষে কথা বলেন, এবং কর্পোরেট-পুঁজিবাদের জমানায় গিয়ে ব্যক্তির ধারণাকে কীভাবে নতুন করে ব্যাখ্যা করা হবে সে-ব্যাপারে ১৭৯০ সালে লেখার সময় অবশ্যই তার কোনো ধারণা ছিল না। ‘‘তিনি এই ভবিষ্যৎ দেখতে পাননি’’, আমি এখন নৈরাজ্যবাদী ইতিহাস-রচয়িতা রুডল্ফ্ রকারের উদ্ধৃতি দিচ্ছি,

 

তিনি এই ভবিষ্যৎ দেখতে পাননি যে, গণতন্ত্র (আইনের কাছে সকল নাগরিকের সমতার মডেল সহকারে) এবং উদারনীতিবাদ (নিজস্ব ব্যক্তিসত্তার উপর মানুষের অধিকার সহকারে) উভয়ই পুঁজিবাদী অর্থনীতির উপর আছড়ে পড়ে ভেঙ্গে যাবে।


আগে থাকতে হামবোল্ট দেখতে পাননি যে, লুণ্ঠনজীবী পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ঘটানো একটা চূড়ান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়াবে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য, প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। নিঃসন্দেহে আমি ইতিবাচক অর্থেই বলছি।

কার্ল পোলানির কথা বলা যায়। সুনির্দিষ্টভাবে তিনি দেখিয়েছেন:

 

বাজার যদি নিজে-নিজে খাপ-খাইয়ে চলতে চাইত, তাহলে তার পক্ষে সমাজের মানবীয় ও প্রাকৃতিক সারবস্ত্তকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন না-করে টিকে থাকা সম্ভব হতো না, কোনো মেয়াদের জন্যই না। এটা একদম দৈহিকভাবেই মানুষকে ধ্বংস করে দিত, আর তার পরিপার্শ্বকে বানিয়ে ফেলত ঊষর বিরাণ প্রান্তর।


আমার মনে হয় কথাটা ঠিক। শ্রমের পণ্য-চরিত্রের ফলাফলও হামবোল্ট আগে থাকতে দেখতে পান নি। মতবাদটা হচ্ছে, আবারও পোলানির ভাষায় বলা যাক,
 

পণ্যের পক্ষে এটা নির্ধারণ করা সম্ভব না যে, কোথায় এটা বিক্রির জন্য হাজির করা হবে, কী কাজে এটা ব্যবহার করা উচিত হবে, কী কায়দায় এটা ভোগ করা বা ধ্বংস করা উচিত হবে।


কিন্তু এক্ষেত্রে পণ্যটা অবশ্যই মানব-জীবন। সুতরাং ধ্রুপদী মুক্তবাজারের অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ আটকানোর জন্য সামাজিক রক্ষাকবচ ছিল একটা নূন্যতম প্রয়োজন।

হামবোল্ট ১৭৯০ সালে এটাও বোঝেননি যে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সম্পর্ক এক প্রকার দাসত্ব-বন্ধনকে চিরস্থায়ী করে তুলেছিল, যাকে আসলে আরও বহু আগে, ১৭৬৭ সালে, সাইমন লিঙ্গুয়েট ‘‘এমনকি দাসপ্রথার চেয়েও খারাপ’’ বলে ঘোষণা করেছিলেন এই কথাগুলো লেখার মাধ্যমে:

 

অন্য যেকোনো উপায়ে বেঁচে থাকার জন্য এটা একটা অসম্ভব পরিস্থিতি--যা আমাদের খামার-শ্রমিকদেরকে বাধ্য করে সেই জমি চাষ করতে, যার ফসল তাঁরা খাবেন না; এবং আমাদের রাজমিস্ত্রিদেরকে বাধ্য করে সেই ইমারত গড়তে, যার ভেতরে তাঁরা বাস করবেন না। অভাব হচ্ছে সেই জিনিস, যা তাঁদেরকে ঐসব বাজারে টেনে নিয়ে যায়, যেখানে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন প্রভুদের জন্য, যাঁরা তাঁদেরকে কেনার মতো দয়া দেখাবেন। অভাব হচ্ছে সেই জিনিস, যা তাঁদেরকে বাধ্য করে ধনী লোকের কাছ থেকে তাঁকেই আরো ধনী বানানোর অনুমতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে নত হতে। দাসপ্রথার অবদমন তাঁর জন্য কার্যকর কী অর্জন এনে দিয়েছে? আপনি বলবেন, ‘সে স্বাধীন’। সেটা তার দুর্ভাগ্য। বলা হয়ে থাকে, এসব মানুষের কোনো মালিক বা প্রভু নাই। তাঁদের আছে প্রভুদের মধ্যে সবচেয়ে ভীতিকর, সবচে কর্তৃত্বপরায়ন যে-প্রভু: সেই অভাব। এ হলো সেই জিনিস, যা তাঁদেরকে সবচেয়ে নির্মম নির্ভরশীলতায় পর্যবসিত করে।


দাসত্ব-বন্ধনের ধারণার মধ্যে যদি মানব-স্বভাবের জন্য অমর্যাদাজনক কিছু থেকে থাকে (আলোকায়নের প্রত্যেক মুখপাত্র যেমনটা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করে থাকেন), তাহলে তার মানে এই দাঁড়ায় যে, নতুন একটা বন্ধন-মুক্তি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে, ফুরিয়ার যাকে ইতিহাসের তৃতীয় এবং শেষ বন্ধন-মুক্তির পর্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। প্রথমটা ক্রীতদাসদেরকে ভূমিদাস বানিয়েছিল, দ্বিতীয়টা ভূমিদাসদের বানিয়েছে মজুরিজীবী, তৃতীয়টা প্রলেতারিয়েতকে বানাবে স্বাধীন মানুষ: শ্রমের পণ্য-চরিত্র উচ্ছেদ করার মাধ্যমে, মজুরি-দাসত্বের পরিসমাপ্তি ঘটানোর মাধ্যমে এবং বাণিজ্যিক, শিল্পভিত্তিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনার মাধ্যমে।

এগুলো হচ্ছে সেই সব জিনিস, যা হামবোল্ট তাঁর উদারনীতিবাদী মতবাদে প্রকাশ করেননি এবং দেখেননি কিন্তু আমার মনে হয় তিনি হয়ত এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণই করতেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি অবশ্যই স্বীকার করেন যে, সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বৈধ, ‘‘যদি স্বাধীনতা সেই শর্ত-পরিস্থিতিকেই ধ্বংস করে দেয়, যা না থাকলে শুধু স্বাধীনতাই নয়, খোদ অস্তিত্বই অচিন্তনীয় হয়ে পড়ে’’। আর, এটাই তো সেই পরিস্থিতি, যার উদ্ভব ঘটে অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে এবং আমি তাঁর যেসব মন্তব্যেরউদ্ধৃতি দিয়েছি, সেরকমভাবে জোরের সাথে তিনি নিন্দা করেছেন শ্রমের বিচ্ছিন্নতাকে। যে-উপলক্ষেই লেখা হোক না কেন, আমলাতন্ত্র এবং স্বৈরাচারী রাষ্ট্র সংক্রান্ত তাঁর সমালোচনা আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃখদায়ক দিকগুলোর কোনো কোনোটা সম্পর্কে অত্যন্ত ভালো ভাষায় লেখা আগাম সতর্কবাণী হিসেবে গ্রহণযোগ্য; এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে এই যে, তাঁর সমালোচনার ভিত্তিটাকে তিনি যতটা কল্পনা করেছিলেন তার চেয়ে আরও অনেক বেশি বলপ্রয়োগমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রেও, বিশেষত শিল্প-পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্ষেত্রে, প্রয়োগ করা যায়।

যদিও তিনি একটা ধ্রুপদী উদারনীতিক মতবাদের অভিপ্রকাশ ঘটান, তাই বলে হামবোল্ট কিন্তু কোনো আদিম ব্যক্তিতন্ত্রবাদী নন, যেমনটা ছিলেন, ধরুন রুশো। যে-বর্বর তার নিজের মধ্যেই বসবাস করে, রুশো তার উচ্চ প্রশংসা করেন, কিন্তু হামবোল্টের অন্তর্দৃষ্টি একদমই আলাদা। তাঁর মন্তব্যগুলোরসারকথা তিনি এভাবে পেশ করেন,

 

এই প্রবন্ধে উন্মোচিত ভাবধারা এবং যুক্তিমালার সামগ্রিক মর্মবস্ত্তটিকে বেশ ভালোভাবেই এই কটি কথায় বলা যেত: যখন তারা মানব-সমাজের সমস্ত শেকল ভেঙ্গে ফেলবে, তখন তারা যত-বেশি-সম্ভব নতুন সামাজিক বন্ধন খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। বিচ্ছিন্ন মানুষ শৃঙ্খলিত মানুষের তুলনায় অধিকতর বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় না।


এবং তিনি আসলে অগ্রসর হন রাষ্ট্র বা অন্য কোনো কর্তৃত্বপরায়ন প্রতিষ্ঠানের বলপ্রয়োগ থেকে মুক্ত স্বাধীন সমিতিসমূহ নিয়ে গঠিত একটা সমাজ-সম্প্রদায়ের দিকে, যেখানে স্বাধীন মানুষ সৃজন করতে পারবে, অনুসন্ধান করতে পারবে এবং তাদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ বিকাশ অর্জন করতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে, নিজের সময় থেকে অনেক বেশি এগিয়ে, তিনি একটি নৈরাজ্যবাদী অন্তর্দৃষ্টি পেশ করেছিলেন, যা সম্ভবত শিল্পায়িত সমাজের পরবর্তী পর্যায়ের জন্যই মানানসই। আমরা সম্ভবত এমন একটা দিনের প্রত্যাশা করতে পারি, যখন এইসব আলাদা আলাদা ধারাকে মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের সাধারণ একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা যাবে। মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র এমন একটা সামাজিক রূপ, আজকের দিনে যার অস্তিত্ব নাই বললেই চলে, যদিও এর উপাদানগুলোকে সম্ভবত অনুধাবন করা সম্ভব। অনুধাবন করা সম্ভব, যেমন ধরুন, ব্যক্তিগত অধিকারের নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে, যা এত দিনে অর্জন করেছে তার পূর্ণতম বাস্তবায়ন (যদিও পশ্চিমা গণতন্ত্রসমূহে এখনও তা করুণভাবে বাধাগ্রস্থ হয়ে আছে); অথবা অনুধাবন করা সম্ভব, যেমন ধরুন, ইসরায়েলী কিববুৎজিম-এর মধ্য দিয়ে, বা যুগোস্লাভিয়ার শ্রমিক-পরিষদের পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে, অথবা জনসচেতনতা জাগানোর বা সামাজিক প্রক্রিয়াতে নতুন ধারার সম্পৃক্ততা সৃষ্টি করার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে, যা তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবসমূহের মৌলিক একটা উপাদান, যা আবার অস্বস্তিকরভাবে সহাবস্থান করে সমর্থন-অযোগ্য কর্তৃত্বপরায়ন আচার-অনুশীলনের সাথে।

তাহলে প্রথম এই প্রসঙ্গটার সার সংক্ষেপ করা যাক। রাষ্ট্র সম্পর্কিত প্রথম যে-অবস্থানটিকে আমি একটি আলোচ্য প্রসঙ্গ হিসেবে দাঁড় করিয়েছি, সেটি হল ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী অবস্থান। এর মতবাদ হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে পরিসীমিত করা উচিত, কিন্তু এই সুপরিচিত বৈশিষ্ট্যায়নখানি অত্যন্ত ভাসাভাসা গোছের। অধিকতর গভীরভাবে দেখলে, ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি মানুষের স্বভাব সংক্রান্ত একটি বিশেষ ধারণা থেকে গড়ে ওঠে। এটা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি যা বৈচিত্র্য ও স্বাধীন সৃজনের উপর গুরুত্বারোপ করে। আর এই জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গিটি শিল্প-পুঁজিবাদ, মজুরি-দাসত্ব, বিচ্ছিন্ন শ্রম এবং এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন সংক্রান্ত উঁচু-থেকে-নিচু ক্রমবিন্যাস-কাঠামো ও কর্তৃত্বপরায়ন নীতিমালার সাথে মৌলিকভাবে বিরোধপূর্ণ। উদারনীতিবাদী চিন্তাধারা-অন্তত এর হামবোল্টীয় চেহারায়-মালিকানা-প্রবণ ব্যক্তিতন্ত্রের ধ্যানধারণারও বিরোধী, যেসব ধ্যানধারণা পুঁজিবাদী মতাদর্শের সহজাত। ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ তাই সামাজিক শৃঙ্খল উচ্ছেদ করতে চায়, কিন্তু তার জায়গাটা পূরণ করতে চায় সামাজিক বন্ধন দিয়ে-প্রতিযোগিতামূলক লোভ দিয়ে নয়, লুণ্ঠনজীবী ব্যক্তিতন্ত্র দিয়ে নয়, আর কর্পোরেট-সাম্রাজ্য দিয়ে তো অবশ্যই নয় (তা সেটা রাষ্ট্রীয়-ই হোক, বা ব্যক্তিখাতেরই হোক)। সুতরাং, ধ্রুপদী মুক্তিপরায়ন চিন্তাধারার সাথে যখন শিল্প-পুঁজিবাদ সংক্রান্ত উপলব্ধি যুক্ত হয় তখন তা, আমার মনে হয়, সরাসরি মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের দিকে, বা আপনি চাইলে বলতে পারেন নৈরাজ্যবাদের দিকে, অগ্রসর হয়।



মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র


আচ্ছা, দ্বিতীয় যে আলোচ্য বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই, সেটা হলো রাষ্ট্র সম্পর্কে মুক্তিপরায়ন সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকল্প। নৈরাজ্যবাদের প্রতি খানিকটা সহানুভূতিপূর্ণই বটে, এমন একজন ফরাসী লেখক একদা লিখেছিলেন, ‘‘নৈরাজ্যবাদের আছে একটা চওড়া পিঠ, কাগজ যেমন এও তেমনি, যেকোনো কিছুই সহ্য করে’’। আর নৈরাজ্যবাদের অনেক রকমফের আছে এবং তার মধ্যে মাত্র একটাই আমার বিবেচ্য বিষয়, সেটা হলো বাকুনিনের নৈরাজ্যবাদ, যিনি ১৮৬৫ সালে তাঁর নৈরাজ্যবাদী ইশতেহারে লিখেছিলেন যে, ‘‘নৈরাজ্যবাদী হতে হলে প্রথমেই সমাজতন্ত্রী হতে হবে’’। আমার আগ্রহ ১৮৮৬-র হে-মার্কেট-ঘটনার অন্যতম শহীদ অ্যাডল্ফ ফিশারের নৈরাজ্যবাদের প্রতি, যিনি বলেছিলেন, প্রত্যেক নৈরাজ্যবাদীই একেকজন সমাজতন্ত্রী, কিন্তু প্রত্যেক সমাজতন্ত্রীই একেকজন নৈরাজ্যবাদী নন।

পূর্বাপর সঙ্গতিপূর্ণ একজন নৈরাজ্যবাদীকে অবশ্যই উৎপাদনের উপায়সমূহের ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধিতা করতে হবে। এই ধরণের সম্পত্তি সত্যিই চুরি, প্রুধোঁ তার সেই বিখ্যাত মন্তব্যে যেমনটি বলেছিলেন। কিন্তু পূর্বাপর সঙ্গতিপূর্ণ একজন নৈরাজ্যবাদী বিরোধিতা করবেন সরকার কর্তৃক উৎপাদন চালানোর বন্দোবস্তেরও। আমি উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

 

এর মানে হলো রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র, অর্থাৎ উৎপাদনের উপর রাষ্ট্রের কর্ম-কর্তাদের হুকুম আর কারখানায় ম্যানেজার, বিজ্ঞানী, কারখানা-কর্মকর্তাদের হুকুম। শ্রমিকশ্রেণীর লক্ষ্য হলো শোষণ থেকে মুক্তি। বুর্জোয়াদের সরিয়ে সেখানে নতুন একটা শাসক-পরিচালক-শ্রেণী নিজেদেরকে বসিয়ে দিলে এই লক্ষ্য অর্জিত হয় না, অর্জন করা যায় না। শ্রমিক-পরিষদের কোনো একটা রূপকাঠামোর মাধ্যমে শ্রমিকেরা নিজেরা উৎপাদনের প্রভু হয়ে উঠলেই কেবল সেটা বাস্তবায়িত হতে পারে।


ঘটনাক্রমে, এসব মন্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে বামধারার মার্কসবাদী অ্যান্টন প্যানেকোয়েক-এর রচনা থেকে, এবং লেনিন যাকে শিশুসুলভ অতি-বামপন্থা [মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের বঙ্গানুবাদে ‘বামপন্থী শিশুরোগ’--অনুবাদক] বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, সেই র‌্যাডিক্যাল মার্কসবাদ আসলে নৈরাজ্যবাদী স্রোতোধারাসমূহের সাথে একীভূত হয়ে যায়।

এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আমার মনে হয়। বাম-অভিমুখীন মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রী নৈরাজ্যবাদের একই কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিত হওয়ার আরেকটা নজির দেওয়া যাক। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সংক্রান্ত এই চিত্রায়নটি সম্পর্কে ভেবে দেখুন:

 

রাষ্ট্রীয় মালিকানা আমলাতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া আর কিছুতে পর্যবসিত হতে পারে বলে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা মানেন না। রাষ্ট্র কেন গণতান্ত্রিকভাবে শিল্প-কল-কারখানাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তা আমরা দেখেছি। শিল্প-কল-কারখানার গণতান্ত্রিক মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব শুধু শ্রমিকদের দ্বারা, যাঁরা সরাসরি নিজেদের পর্যায়ের লোকজনের মধ্য থেকে শিল্প-কারখানার প্রশাসনিক কমিটি নির্বাচিত করবেন। মূলগতভাবে সমাজতন্ত্র হবে একটা শিল্পায়িত ব্যবস্থা। এর একেকটা এলাকার নির্বাচকমন্ডলী হবে শিল্পকারখানা-মুখীন চরিত্রের। এভাবে, সামাজিক প্রশাসনের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্ব ঘটবে তাঁদের, যাঁরা সামাজিক কাজকর্মাদি এবং সমাজের শিল্পকারখানাভিত্তিক শ্রমকর্মসমূহের দায়িত্ব বহন করেন। এভাবে, কর্মদায়িত্ব-বহনকারী এবং সমাজ-সম্প্রদায়ের চাহিদা সম্পর্কে গভীরভাবে অবগত মানুষজনের কাছ থেকে উৎসারিত হয়ে এ-ধরণের প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রবাহিত হবে ওপরের দিকে। কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক শিল্পকারখানা-কমিটি যখন বসবেন, সামাজিক কাজকর্মের প্রতিটা পর্যায়কে তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করবেন। তার মানে পুঁজিবাদী রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক রাষ্ট্রের বদলে স্থাপিত হবে সমাজতন্ত্রের শিল্পকারখানাভিত্তিক প্রশাসনিক-কমিটি। একটা সমাজব্যবস্থা থেকে অন্য আরেকটায় উত্তরণই হচ্ছে সমাজবিপ্লব। পুরো ইতিহাস জুড়ে রাজনৈতিক রাষ্ট্র বলতে বুঝিয়েছে শাসকশ্রেণীর লোকজনদের সরকার। সমাজতন্ত্রের জনতন্ত্র (রিপাবলিক) হবে শিল্পকারখানার সরকার, যা পরিচালিত হবে পুরো সমাজ-সম্প্রদায়ের পক্ষে। আগেরটার অর্থ ছিল অধিকাংশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাধীনতা, পরেরটার অর্থ দাঁড়াবে সকলের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। সুতরাং এটা হবে সত্যিকারের গণতন্ত্র।


এই কথাগুলো নেওয়া হয়েছে রাষ্ট্র: এর উৎপত্তি ও কাজ নামক একটা বই থেকে। বইটা উইলিয়াম পলের লেখা, ১৯১৭ সালের প্রথম দিকে। লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব-এর ঠিক আগে, যা লেনিনের সবচেয়ে মুক্তিপরায়ন রচনাকর্ম। উইলিয়াম পল বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, পরে বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র নিয়ে তাঁর পর্যালোচনা নৈরাজ্যবাদীদের মুক্তিপরায়ন মতধারার একেবারে হুবহু প্রায়, বিশেষত এই নীতির প্রশ্নে যে, রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত হতেই হবে, তার বদলে সমাজবিপ্লবের গতিধারায় বসাতে হবে সমাজের শিল্পকারখানাভিত্তিক সংগঠন। প্রুঁধো ১৮৫১ সালে লিখেছিলেন, সরকারের বদলে যা আমরা বসাতে চাই, তা হচ্ছে শিল্পকারখানাভিত্তিক সংগঠন। এরকম আরো অনেক অনেক মন্তব্যের উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে। নির্যাসের দিক দিয়ে, এটা হচ্ছে নৈরাজ্যবাদী বিপ্লবীদের মূলগত ভাবধারা।

এরকম আরও অনেক কথার উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে। তবে তার চেয়েও যেটা বেশি জরুরী সেটা হলো, স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবী কর্মকান্ডে এসব ভাবধারা বাস্তবায়িত হয়েছে অনেক বার, যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানীতে আর ইতালিতে, ক্যাটালোনিয়ায় [স্পেনের একটি প্রদেশ] ১৯৩৬-এ। কেউ হয়ত এই যুক্তি দেখাতে পারেন, অন্ততপক্ষে আমি তো তা দেখাবোই যে, লম্বা উদ্ধৃতিটা আমি যে-অর্থে পড়লাম সেই অর্থে কাউন্সিল কমিউনিজম হচ্ছে শিল্পায়িত সমাজে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের স্বাভাবিক রূপ। এটা অর্ন্তজ্ঞানলব্ধ এই উপলব্ধির প্রকাশ ঘটায় যে, শিল্পব্যবস্থা যখন স্বৈরাচারী অভিজাত শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে থাকে (সেই অভিজাতরা মালিক, ম্যানেজার, কারিগরী কলাকুশলী, ভ্যানগার্ড পার্টি, রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র বা অন্য যাঁরাই হোন না কেন), গণতন্ত্র তখন অনেকাংশেই একটা ছলনা। কর্তৃত্বপরায়ন আধিপত্যের এরকম পরিস্থিতিতে ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী আদর্শসমূহ (মার্কস এবং বাকুনিন এবং সত্যিকারের অন্যসব বিপ্লবীরা যার প্রকাশ ঘটিয়েছেন) বাস্তবায়ন করা যাবে না; অনুসন্ধান এবং সৃজন করার মতো, নিজের সুপ্ত সম্ভাবনাগুলোর পূর্ণতম বিকাশ ঘটানোর মতো স্বাধীন হবে না মানুষ, মানব সত্তার একটা টুকরো হয়েই থেকে যাবে শ্রমিক-অধঃপতিত হয়ে, উপর থেকে চালানো উৎপাদন-প্রণালীর একটা যন্ত্র হয়ে।

এবং এই অর্থে বিপ্লবী মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের ভাবধারা গত অর্ধ শতকে শিল্পায়িত সমাজগুলোতে অন্তর্লীন হয়ে থেকেছে, আর আধিপত্যশীল ভাবধারা হিসেবে থেকেছে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। কিন্তু গত দুই-এক বছরে কৌতূহল জাগানোর মতো পুনরুত্থান ঘটেছে। অ্যান্টন প্যানেকোয়েকের যে-প্রতিপাদ্যটি থেকে আমি উদ্ধৃতি দিলাম, সেটা আসলে নেওয়া হয়েছে ফরাসী শ্রমিকদের র‌্যাডিক্যাল একটা গ্রুপের প্রচার-পুস্তিকা থেকে। আর বিপ্লবী সমাজতন্ত্র সম্পর্কে উইলিয়াম পলের উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে ওয়াল্টার কেন্ডলের একটা প্রবন্ধ থেকে। গত মার্চে ইংল্যান্ডের শেফিল্ডে অনুষ্ঠিত শ্রমিক-কর্তৃত্ব সংক্রান্ত জাতীয় সম্মেলনে এটি পড়া হয়েছিল। ফরাসী ও ইংরেজ এই উভয় গ্রুপই গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিসের প্রতিনিধিত্ব করে। বিশেষত গত কয়েক বছরে ইংল্যান্ডের শ্রমিক-কর্তৃত্ব-আন্দোলন, আমার মনে হয়, গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ একটা শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যেমন ধরুন, সবচেয়ে বড় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কয়েকটা এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। সম্মিলিত প্রকৌশল ফেডারেশন [সম্ভবত ‘সম্মিলিত প্রকৌশল ইউনিয়ন’], আমার মনে হয় এটা ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন, এসব মূলনীতিকে তাদের ভিত্তিগত ভাবধারা হিসেবে গ্রহণ করেছে। ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো সম্মেলন করেছে তারা, যা থেকে বেরিয়ে এসেছে আগ্রহ-জাগানিয়া পুস্তিকা-সাহিত্য এবং [ইউরোপ] মহাদেশে একই রকমের ঘটনা আরো আছে। ফ্রান্সে ও জার্মানীতে কাউন্সিল কমিউনিজম এবং সমজাতীয় ভাবধারার প্রতি এবং মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের অন্যান্য রূপকাঠামোর প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে ফ্রান্সের মে-১৯৬৮ নিশ্চয়ই আরো বাড়িয়েছে, যেমনটা তা বাড়িয়েছে ইংল্যান্ডেও।

অতিরিক্ত মতাদর্শায়িত আমাদের এই সমাজের মোটের উপর রক্ষণশীল ছাঁচের কারণে এটা খুব বিস্ময়কর নয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসব ঘটনার স্পর্শ লাগেনি। কিন্তু সেটাও বদলে যেতে পারে। ঠান্ডা যুদ্ধের ক্ষয়ে যাওয়াটা এসব প্রসঙ্গের কোনো কোনোটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করাকে অন্তত সম্ভব করে তুলেছে। আর নিপীড়ণের বর্তমান ঢেউকে যদি ফিরিয়ে দেয়া যায়, পরাভূত করা যায়, বামরা যদি তাঁদের অধিকতর আত্মহত্যাপ্রবণ ঝোঁকগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারেন এবং বিগত দশকের অর্জনগুলোর উপর নির্ভর করে দাঁড়াতে পারেন, তাহলে সমাজ-সম্প্রদায়ে ও কর্মক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ সহকারে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পথে শিল্পায়িত সমাজকে গড়ে তোলার সমস্যাটাই সমসাময়িক সমাজের সমস্যাসমূহ সম্পর্কে যাঁরা সচেতন তাঁদের কাছে প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক প্রসঙ্গ হয়ে উঠবে। আর, বিপ্লবী মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের জন্য গণআন্দোলন যখন গড়ে উঠবে, আমার প্রত্যাশা সেটাই ঘটবে, অনুমান তখন কাজের দিকে অগ্রসর হবে।

আমি যেমনটা করেছি, সেভাবে বাম-মার্কসবাদ ও নৈরাজ্যবাদকে লাল রঙে ছাপানো একই শিরোনামের অধীনে একত্র করাটাকে কারো কারো কাছে উচ্চ-অথচ-অলীক আদর্শের অনুগামী কাজ বলে মনে হতে পারে, কেননা গত শতাব্দী জুড়ে মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে বজায় ছিল বৈরিতা, যার সূত্রপাত ঘটে একপক্ষে মার্কস ও এঙ্গেলস এবং অন্য পক্ষে, ধরা যাক প্রুঁধো ও বাকুনিনের মধ্যকার বৈরিতা দিয়ে। অন্ততপক্ষে উনবিংশ শতকে রাষ্ট্র প্রশ্নে তাঁদের পার্থক্য ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু এক অর্থে সেটা ছিল কৌশলগত। নৈরাজ্যবাদীদের ছিল এই দৃঢ় প্রত্যয় যে, পুঁজিবাদ এবং রাষ্ট্রকে একই সঙ্গে ধ্বংস করতে হবে। এঙ্গেলস ১৮৮৩ সালের এক চিঠিতে এই ভাবধারা প্রসঙ্গে তাঁর বিরোধিতা প্রকাশ করেছিলেন:

 

নৈরাজ্যবাদীরা মাথার দিকটা নিচে দিয়ে জিনিসটাকে উল্টোভাবে খাড়া করেন। তাঁরা ঘোষণা করেন যে, রাজনৈতিক বিপ্লবকে অবশ্য-অবশ্যই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংগঠন বাতিল করে দেওয়ার মাধ্যমে শুরু করতে হবে। কিন্তু এরকম একটা মুহূর্তে এটা ধ্বংস করা মানে হচ্ছে সেই একমাত্র অঙ্গটিকে ধ্বংস করা, যা দিয়ে বিজয়ী প্রলেতারিয়েত তার নববিজিত ক্ষমতা ঘোষণা করতে পারে, প্রতিপক্ষকে দাবিয়ে রাখতে পারে এবং সমাজের সেই অর্থনৈতিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারে, যেটা না-করলে নিঃসন্দেহে পুরো বিজয়টার পরিসমাপ্তি ঘটবে নতুন একটা পরাজয়ের মধ্যে, এবং প্যারি কমিউনের পর যেমন ঘটেছিল, শ্রমিকদের সেরকম গণহত্যার মধ্যে।


এখন কথা হলো, আমার মনে হয় এ-কথা নায্যভাবেই বলা চলে, প্যারি কমিউন মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের--আপনি চাইলে বলতে পারেন নৈরাজ্যবাদের--ভাবধারা তুলে ধরেছিল, এবং নিঃসন্দেহে মার্কস এ-সম্পর্কে মহা-উৎসাহে লিখেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, কমিউনের অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা সংক্রান্ত তাঁর ধ্যানধারণা পরিবর্তন করিয়ে নিয়েছিল, যা আপনি দেখতে পাবেন, ধরুন, কমিউনিস্ট ইশতেহার-এর ভূমিকায় চোখ বুলালে (এই সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭২-এ), এবং তাঁকে দিয়ে গ্রহণ করিয়ে নিয়েছিল সমাজবিপ্লবের প্রকৃতি সংক্রান্ত অধিকতর নৈরাজ্যবাদী পরিপ্রেক্ষিত জাতীয় কিছু একটা ব্যাপারকে।

ঠিক আছে, কমিউনকে অবশ্যই রক্তে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল, স্পেনের কমিউনগুলো যেমন ধ্বংস করা হয়েছিল ফ্যাসিবাদী এবং কমিউনিস্ট সেনাবাহিনী দিয়ে। আর এ-কথাও হয়ত বলা যাবে যে, অধিকতর একনায়কসুলভ কাঠামো এসব সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিপ্লবটাকে রক্ষা করতে পারত। কিন্তু তাতে আমার খুবই সন্দেহ আছে। অন্ততপক্ষে স্পেনের ঘটনায়, আমার মনে হয়, অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ মুক্তিপরায়ন নীতিমালাই বিপ্লবটার সম্ভাব্য একমাত্র প্রতিরক্ষা জোগাতে পারত। এ-কথায় পাল্টা তর্ক তোলা যাবে অবশ্যই এবং এটা একটা লম্বা কাহিনী, যার মধ্যে আমি এখন ঢুকতে চাই না, কিন্তু খুব কম করে হলেও এটুকু পরিষ্কার যে, গত অর্ধ শতাব্দীর ঘটনাসমূহের পরও ‘লাল আমলাতন্ত্র শতাব্দীর সবচেয়ে সহিংস, ভয়াবহ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে’ এই মর্মে বাকুনিনের উপর্যুপরি সতর্কীকরণের মধ্যকার সত্যতাটুকু দেখতে ব্যর্থ হতে হলে আপনাকে হাস্যকর রকমের সরলমনা হতে হবে। একবার তিনি বলেছিলেন, ১৮৭০ সালে বলেছিলেন, ‘‘সবচেয়ে র‌্যাডিক্যাল বিপ্লবীকে আনুন এবং তাকে নিখিল রাশিয়ার সিংহাসনে বসিয়ে দিন, অথবা তাকে একনায়কের ক্ষমতা দিয়ে দিন এবং এক বছর পার হওয়ার আগেই তিনি খোদ জারের চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে পড়বেন’’। আমার ভয় হয়, এ-প্রসঙ্গে বাকুনিন প্রত্যাশার চেয়ে একটু বেশিই উপলব্ধিপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন এবং এই ধরণের হুঁশিয়ারী বামপন্থীদের পক্ষ থেকে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। যেমন ধরুন অরাজক-সমাজতন্ত্রী ফার্নান্দ পিলোতিয়ের ১৮৯০-এর দশকে প্রশ্ন তুলেছিলেন:

 

এমনকি অপরিহার্যভাবে এবং নিয়তি-নির্ধারিতভাবে আমাদের সহ্য করতে হবে যে-রাষ্ট্রকে, অস্থায়ী সেই রাষ্ট্রও কি অবশ্য-অবশ্যই একটা যৌথতাবাদী কারাগারে পরিণত হবে? এটা কি স্বাধীন একটা সংগঠন হিসেবে বিদ্যমান থাকতে পারে না, সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করে দিয়ে যা সীমাবদ্ধ থাকবে পুরোপুরিভাবে উৎপাদন ও ভোগ সংক্রান্ত চাহিদাসমূহের মধ্যে?


আমি ভান করছি না যে, এ-প্রশ্নের উত্তর আমি জানি, কিন্তু আমার মনে হয়, এটা সহনীয় মাত্রায় স্পষ্ট যে, উত্তরটা যদি ইতিবাচক না-হয় তাহলে বামপন্থীদের মানবতান্ত্রিক আদর্শগুলো অর্জন করার মতো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সুযোগ বরং সামান্যই। আমার মনে হয় মার্টিন বুবার সমস্যাটাকে একদম চুম্বক-কথায় তুলে ধরেছিলেন, যখন তিনি বলেছিলেন: ‘‘বস্ত্ত-প্রকৃতিতে কেউ আশা করতে পারেন না যে, যে-ছোট গাছটিকে মুগুরে পরিণত করা হয়েছে, সেখান থেকে আবার পাতা গজাবে।’’ ঠিক এই কারণে, পুঁজিবাদী দুনিয়ার যেকোনো জায়গায় র‌্যাডিক্যাল ধরণের গণতান্ত্রিক সমাজ-রূপান্তরের কোনো যুক্তিপূর্ণ সম্ভাবনা থাকতে হলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী একটা বৈপ্লবিক আন্দোলন বিদ্যমান থাকাটা অত্যাবশ্যক। এবং তুলনীয় মন্তব্য, আমার মনে হয়, নিঃসন্দেহে রুশ সাম্রাজ্যের বেলাতেও খাটে। লেনিন তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত এই ভাবধারার উপর জোর দিয়ে গেছেন:
 

এটা মার্কসবাদের প্রাথমিক সত্য যে, সমাজতন্ত্রের বিজয়ের জন্য বেশ কয়েকটা অগ্রসর দেশে শ্রমিকদের যৌথ প্রয়াস দরকার। কমসে কম এটুকু দরকার যে, বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের বিরাট কেন্দ্রগুলো প্রতিবিপ্লবী হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে। শুধুমাত্র এরকম সম্ভাবনাই কোনো একটা বিপ্লবকে তার নিজের দেশের বলপ্রয়োগমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ উচ্ছেদ করতে দেবে-যখন নাকি সেই বিপ্লব অর্থনীতিকে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় আছে।


আচ্ছা, আমি তাহলে আরেকবার সারসংক্ষেপ করি। রাষ্ট্র নিয়ে আলোচনার জন্য আমি এখন পর্যন্ত দুইটা আলোচ্য বিষয় উল্লেখ করেছি: ধ্রুপদী উদারনীতিবাদ এবং মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র। তারা একমত যে, রাষ্ট্রের কাজকর্ম হচ্ছে নিপীড়ণমূলক এবং রাষ্ট্রকর্মকে অবশ্যই সীমাবদ্ধ হতে হবে। মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র আরো এগিয়ে গিয়ে জোরের সাথে বলতে থাকে, রাষ্ট্রশক্তিকে অবশ্যই উচ্ছেদ করতে হবে শিল্পায়িত সমাজের গণতান্ত্রিক বিন্যাস-বন্দোবস্তের সপক্ষে, যাতে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রত্যক্ষ সর্বলোকগ্রাহ্য নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাঁদের, যাঁরা সেসব প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন এবং যাঁরা সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হন। তাহলে হয়ত আপনি শ্রমিক-পরিষদ, গ্রহক-ভোক্তা-পরিষদ, কমিউন-সভা, আঞ্চলিক ফেডারেশন ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে গঠিত একটি ব্যবস্থার কথা কল্পনা করতে পারছেন, যে-ব্যবস্থার মধ্যে থাকছে এমন ধরণের প্রতিনিধিত্ব, যা প্রত্যক্ষ ও প্রত্যাহারযোগ্য। প্রত্যক্ষ ও প্রত্যাহারযোগ্য এই অর্থে যে, সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ও একাঙ্গীভূত যে-সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের পক্ষে এই প্রতিনিধিরা কোনো একটা উচ্চতর সংস্থায় কথা বলেন, সেইসব গোষ্ঠীর কাছেই তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন, আর এই গোষ্ঠীগুলোর কাছেই তাঁদেরকে প্রত্যক্ষভাবে ফিরে আসতে হয়। আমাদের প্রতিনিধিত্ব-ব্যবস্থার চেয়ে যে অনেক আলাদা জিনিস, সেটা এমনিতেই বোঝা যাচ্ছে। এখন এ-প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে, জটিল ও উচ্চ মাত্রায় প্রযুক্তিগত একটা সমাজে এরকম সামাজিক কাঠামো কি চলনসই? পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক আছে এবং আমার মনে হয় সেগুলো প্রধানত দুই ধরণের। প্রথম ভাগটা হচ্ছে, এরকম একটা সংগঠন মানুষের স্বভাবের বিপরীতধর্মী। আর দ্বিতীয় ভাগে মোটামুটি এ-রকম বলা হয় যে, কর্মদক্ষতার চাহিদার সাথে এটা অসঙ্গতিপূর্ণ। এই দুইটার প্রত্যেকটাই আমি সংক্ষেপে বিবেচনা করে দেখতে চাই।

প্রথমটা ভেবে দেখুন: মুক্ত-স্বাধীন সমাজ মানুষের স্বভাব-বিরোধী। প্রায়ই প্রশ্ন তোলা হয়: মানুষ কি আসলেই স্বাধীনতা চায়? স্বাধীনতার সাথে যে-দায়দায়িত্ব এসে পড়ে, সেটা কি তারা চায়? নাকি তারা দয়ালু একজন প্রভুর শাসন চায়? এরই সাথে তাল মিলিয়ে, ক্ষমতার বিদ্যমান বিন্যাসের সমর্থকেরা সুখী দাস নামক ধারণাটির এই ভাষ্য বা ঐ ভাষ্যের প্রতি একনিষ্ঠ থেকে যান। দুই শ বছর আগে, চতুর রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে নালিশ তুলেছিলেন রুশো,

 

তাঁরা এই সত্য আড়াল করার জন্য ফন্দি খোঁজেন যে, মানুষের মৌলিক ও নির্ধারক ধর্ম হচ্ছে তার স্বাধীনতা। দাসত্বের প্রতি স্বাভাবিক ঝোঁককে তাঁরা মানুষের ধর্ম বলে চালাতে চান। তাঁরা ভেবে দেখেন না যে, স্বাধীনতা এবং নিষ্পাপতা ও সৎকর্মের প্রতি স্বাভাবিক ঝোঁকও মানুষের ধর্ম। ততক্ষণ পর্যন্ত এসবের মূল্য বোঝা যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তা উপভোগ করে, এবং যখন সে এগুলোকে হারিয়ে ফেলে, তখনই তার এসবের প্রতি রুচি নষ্ট হয়ে যায়।


--এভাবেই বলেছিলেন তিনি। এই মতধারার প্রমাণ হিসেবে তিনি সেই সব বিস্ময়কর কাজকর্মের কথা উল্লেখ করেন, নিষ্ঠুর শাসনের হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য স্বাধীন জনগোষ্ঠীসমূহ যা সম্পাদন করে থাকে। তিনি বলেন,
 

এ-কথা সত্য যে, স্বাধীন মানুষের জীবন যাঁরা পরিত্যাগ করেছেন, তাঁরা তাঁদের শৃঙ্খলের মধ্যে যে-শান্তি ও বিশ্রাম উপভোগ করেন, সে-সম্পর্কে অবিরামভাবে গর্ববোধ করা ছাড়া তাঁরা আর কিছুই করেন না। কিন্তু যখন আমি অন্যদেরকে দেখি, এই একটিমাত্র শুভবস্ত্তকে বাঁচানোর জন্য তাঁরা তাঁদের সুখ বিশ্রাম সম্পদ ক্ষমতা এবং খোদ জীবনকে পর্যন্ত উৎসর্গ করে দিচ্ছেন (অথচ এই একই জিনিস তাঁদের কাছে অতি ঘৃণিত বস্ত্ত যাঁরা সেটা হারিয়ে ফেলেছেন), যখন আমি দেখি বিপুল সংখ্যক পুরোপুরি নগ্ন বর্বর মানুষ ইউরোপীয় ইন্দ্রিয়পরায়নতাকে তাচ্ছিল্য করছেন, আর শুধু তাঁদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য সহ্য করছেন ক্ষুধা আগুন তরবারী এবং মৃত্যুকে, তখন আমার মনে হয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত যুক্তিতক্কো দাসদের পক্ষে শোভা পায় না।


এটা এমন একটা মন্তব্য, সম্ভবত আমরা যার সমকালীন একটা ভাষ্য দাঁড় করাতে পারি।

বলতে গেলে একই রকম চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কান্ট আরও ৪০ বছর পরে। তিনি বলেছিলেন, তিনি একথা মেনে নিতে পারেন না যে, কিছু কিছু লোক, যেমন কোনো কোনো ভূস্বামীর ভূমিদাসেরা, স্বাধীনতার যোগ্য নয়। তিনি লিখছেন,

 

কেউ যদি এই অনুমান গ্রহণ করেন, তাহলে কোনোদিনই স্বাধীনতা অর্জিত হবে না। কেননা, স্বাধীনতার যথাযোগ্য সাবালকত্বে কেউ পৌঁছাতেই পারবেন না, যদি-না তিনি ইতোমধ্যে স্বাধীনতা অর্জন করে থাকেন। স্বাধীনভাবে নিজের ক্ষমতাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা শিখতে গেলে তাঁকে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। প্রথম উদ্যোগগুলো নিশ্চিতভাবেই হবে নৃশংস এবং নিয়ে যাবে এমন পরিস্থিতির দিকে, যা হবে আগের অবস্থার চেয়ে আরো বেশি বেদনাবহ ও বিপজ্জনক--আগের অবস্থটা বহিঃস্থ একটা কর্তৃপক্ষের আধিপত্যের অধীনে ছিল ঠিকই, কিন্তু তার তত্ত্বাবধানেও তো ছিল। যাই হোক, যুক্তি অর্জন করা যায় শুধু নিজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই এবং সে-সব অভিজ্ঞতার দায়িত্বভার নিতে পারার জন্য তাঁকে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। অন্যের অধীনে যাঁরা থাকেন, তাঁদের জন্য স্বাধীনতা ফালতু একটা ব্যাপার এবং তাঁদেরকে স্বাধীনতা দিতে চিরকালের মতো অস্বীকার করার অধিকার কারো আছে--এই নীতি গ্রহণ করাটা খোদ ঈশ্বরের অধিকারের বিধিলঙ্ঘন বটে, যিনি তাঁদেরকে সৃষ্টি করেছেন স্বাধীনভাবে।


এই বিশেষ মন্তব্যটা এর পটভূমির কারণেও আগ্রহ জাগানোর মতো। ফরাসী বিপ্লবের পক্ষাবলম্বন করে এক্ষেত্রে যুক্তি দেখাচ্ছিলেন কান্ট। আর, যুক্তি দেখাচ্ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস চলাকালে যাঁরা দাবি করছিলেন যে, ত্রাসের ঘটনাই দেখিয়ে দিচ্ছে স্বাধীনতার সুবিধাগুলোর জন্য জনগণ এখনো তৈরি নয়। এবং তাঁর মন্তব্যেরও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা আছে বলে আমার মনে হয়। কোনো মুক্তিপরায়ন লোকই সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে অনুমোদন করবেন না, এবং যখন নাকি বিশেষত বিপ্লব-পরবর্তী নির্মম স্বৈরাচারের হাতে-পড়া রাষ্ট্রের সন্ত্রাস একাধিকবার গিয়ে ঠেকেছে বর্বরতার অবর্ণনীয় মাত্রায়। তবে দীর্ঘকাল যাবত দলিত জনগণ যখন তাদের নিপীড়কদের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ায়, অথবা স্বাধীনতা ও সামাজিক পুনর্গঠনের পথে তাদের প্রথম পদক্ষেপগুলো নেয়, তখন প্রায়শ যে-সহিংসতা ঘটে, কোনো বুঝদার বা মানবিকতাসম্পন্ন মানুষই সাত-তাড়াতাড়ি তার নিন্দা করেন না।

কান্টের ঠিক কয়েক বছর আগে হামবোল্ট একদম একই রকম মত প্রকাশ করেছিলেন। তিনিও বলেছিলেন, মানুষের আত্মবিকাশের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্য।

 

স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনীয় পরিপক্বতা অর্জনে খোদ স্বাধীনতা যতোটা সাহায্য করে, অন্য কিছুই ততোটা সাহায্য করে না। এই অপরিপক্বতাকে প্রায়শ যাঁরা নিপীড়ণ অব্যাহত রাখার ছুতা হিসেবে ব্যবহার করেন, তাঁরা হয়ত এই সত্য স্বীকার করবেন না। কিন্তু আমার মনে হয়, এই সত্যটা প্রশ্নাতীতভাবে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি থেকেই উৎসারিত। নীতিনৈতিকতাগত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার অভাব থেকেই শুধুমাত্র স্বাধীনতার অক্ষমতা দেখা দিতে পারে। সক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলাটাই হচ্ছে ঐ অভাব পূরণের একমাত্র পথ। কিন্তু তা করার পূর্বশর্ত হিসেবে দরকার পড়ে স্বাধীনতার, যা জাগিয়ে তোলে স্বতঃস্ফূর্ত কর্মতৎপরতাকে।


‘‘যাঁরা এটা উপলব্ধি করেন না’’, তিনি বলছেন, ‘‘এই সন্দেহ করা চলে যে, মানুষের স্বভাবকে তাঁরা ভুল বোঝেন এবং মানুষকে মেশিনে পরিণত করার খায়েশ পোষণ করেন।’’

বলশেভিক ভাবাদর্শ ও আচার-অনুশীলন সম্পর্কে রোজা লুক্সেমবার্গের ভাতৃপ্রতীম, সহানুভূতিশীল পর্যালোচনাও প্রায় একই ভাষায় পেশ করা হয়েছিল। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক পুনর্গঠনে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণই কেবল শত শত বছরের বুর্জোয়া শ্রেণী-শাসনে অধঃপতিত জনগণের সেই পরিবর্তন ঘটাতে পারে, যাকে তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন পূর্ণাঙ্গ আধ্যাত্মিক পরিবর্তন হিসেবে, কেননা শুধু তাঁদের সৃজনশীল অভিজ্ঞতা ও স্বতঃস্ফূর্ত কর্মতৎপরতাই পারে মুক্তিপরায়ন সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃজনের পথে শত-সহস্র সমস্যার সমাধান করতে। তিনি আরও বলেছিলেন, সবচাইতে চতুর কেন্দ্রীয় কমিটির নির্ভুলতার চেয়েও সত্যিকারের বিপ্লবী একটা আন্দোলনের কৃত ভুলগুলো ইতিহাসের দিক দিয়ে অপরিসীম বেশি ফলপ্রসূ। এবং আমার মনে হয়, এই মন্তব্যগুলো আত্মাসমৃদ্ধ কর্পোরেশনের কমবেশি সমান্তরাল ভাবাদর্শের ক্ষেত্রেও সরাসরি অনুবাদ করে দেওয়া চলে, যে-ভাবাদর্শটি এখন মার্কিন বিদ্বৎজনদের মধ্যে বেশ ভালোরকম জনপ্রিয়। যেমন ধরুন, কার্ল ক্যাসেন, যিনি লিখছেন,

 

মালিকানার প্রতিনিধি-এজেন্টরা এখন আর বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজেন না। ম্যানেজমেন্ট এখন নিজেকে স্টকহোল্ডার, কর্মচারী, গ্রাহক, সাধারণ পাবলিক এবং সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠান আকারে খোদ ফার্মটির কাছে নিজেকে দায়বদ্ধ হিসেবে দেখে। লোভ কিংবা লালায়িত মনোভাবের কোনো প্রদর্শনী আর নাই। শিল্পোদ্যোগের সামাজিক খরচপত্রের একটা অংশ শ্রমিক আর জনসম্প্রদায়ের ঘাড়ে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা আর নাই। আধুনিক কর্পোরেশন হচ্ছে আত্মাসমৃদ্ধ কর্পোরেশন। [হাসি]


একইরকমভাবে, ভ্যানগার্ড পার্টি হচ্ছে একটা আত্মাসমৃদ্ধ পার্টি। আর উভয় ক্ষেত্রেই এইসব দয়ালু স্বৈরতন্ত্রের কাছে বশ্যতা স্বীকার করার তাগিদ যাঁরা দেন, আমার মনে হয় মানুষকে মেশিন বানানোর বাসনা পোষণ করার দায়ে তাঁদেরকে অভিযুক্ত করা চলে।

এখন এই দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা, যা প্রকাশিত হয়েছে রুশো আর কান্ট আর হামবোল্ট আর লুক্সেমবার্গ এবং আরো অসংখ্য অন্যদের দ্বারা, আমার মনে হয় না এই যথার্থতা ঠিক এখনই বৈজ্ঞানিক প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হবে। এর মূল্যায়ন সম্ভব শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা ও অর্ন্তজ্ঞানের বিচারে। মানুষের জন্মই হয়েছে স্বাধীন হওয়ার জন্য, বা তাদের জন্মই হয়েছে দয়ালু স্বৈরাচারীদের দ্বারা শাসিত হওয়ার জন্য-এই মর্মে দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের সামাজিক পরিণামও চাইলে কেউ চিহ্নিত করতে পারেন।

দ্বিতীয় প্রশ্নটা সম্পর্কে বলার কী আছে, কর্মদক্ষতার প্রশ্নটা? একেবারে ক্ষুদ্রতম কর্ম-একক পর্যন্ত পুরো শিল্পকারাখানা-ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কি কর্মদক্ষতার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ? প্রায়শই কয়েকটা অবস্থানে দাঁড়িয়ে এই যুক্তিটা তুলে ধরা হয়। যেমন ধরুন, কেউ কেউ বলেন, কেন্দ্রায়িত ব্যবস্থাপনা একটা প্রযুক্তিগত বাধ্যতা। কিন্তু আমার মনে হয়, আপনি যদি এটাকে খতিয়ে দেখেন, তাহলে দেখবেন যুক্তিটা অতিমাত্রায় দুর্বল। যে-প্রযুক্তি ম্যানেজারদের বোর্ডের সামনে প্রাসঙ্গিক তথ্য হাজির করে, ঠিক সেই একই প্রযুক্তি একই সময়ে কর্মীবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকের সামনেও সেই একই তথ্য হাজির করতে সক্ষম। মানুষকে উৎপাদনের বিশেষায়িত যন্ত্রে পরিণত-করা হতচেতন শ্রমকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম যে-প্রযুক্তি, নীতিগতভাবে সেই একই প্রযুক্তি শ্রমিকদের জন্য অবকাশ ও শিক্ষার সুযোগও সৃষ্টি করতে পারে, যা তাঁদেরকে ঐ তথ্যাবলী যথোপযুক্তভাবে ব্যবহার করার মতো সক্ষম করে তুলবে। আর তাছাড়া, র‌্যাল্ফ নলোব্যানের বাগধারা ব্যবহার করে বললে বলা যায়, এমনকি যে-অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণী থেকে আত্মা-সমৃদ্ধতা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে, সেই অর্থনৈতিক অভিজাতরাও সিস্টেমের চাপে থাকেন। এই চাপের মধ্যে তাঁরা কাজ চালান ক্ষমতা প্রবৃদ্ধি মুনাফা প্রভৃতি কতিপয় উদ্দেশ্যে উৎপাদন সংগঠিত করার জন্য-মানবীয় চাহিদা-পূরণের জন্য নয়। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি জটিল একটা মাত্রায় দাঁড়িয়ে এসব চাহিদাকে শুধু সামষ্টিক পরিভাষাতেই প্রকাশ করা চলে। নিশ্চিতভাবেই এটা অনুধাবনযোগ্য এবং এমনকি এমন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি যে, লোক-সমস্টির নিজের নেওয়া সিদ্ধান্ত এসব মানবীয় চাহিদা-প্রয়োজন আর স্বার্থসমূহের প্রতিফলন ঘটাবে তো বটেই, আত্মাসমৃদ্ধ নানাবিধ অভিজাতদের চাহিদা-প্রয়োজনেরও প্রতিফলন ঘটাবে।

যা-ই হোক, যে-সমাজে এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিয়োজিত করা হয় অপচয় আর ধ্বংসের পেছনে, সেই সমাজে বসে কর্মদক্ষতা সংক্রান্ত যুক্তিতর্ককে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করাটা একটু কঠিনই বটে। সবাই জানেন, কর্মদক্ষতার ধারণাটাই ভাবাদর্শে ভিজে জবজবে-হওয়া একটা ধারণা। পণ্যের বিস্তার চরমে তোলাটাই সুন্দর জীবনের একমাত্র মানদন্ড নয়। এই বিষয়টা সুপরিচিত, তাই এর কোনো ব্যাখ্যা দরকার নাই।



রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাসমূহ


এখন তাহলে শেষ দুইটা আলোচ্য বিষয়ের দিকে আসি: বলশেভিক-সমাজতন্ত্র বা রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। যেমনটা আমি বলার চেষ্টা করেছি, এমন কিছু বিষয় আছে, যা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য, এবং মজার কিছু দিক দিয়ে এরা ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী আদর্শ থেকে বা তার পরবর্তী সময়ে বিস্তৃত মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্র থেকে দূরে সরে যায়। আমি যেহেতু আমাদের সমাজ নিয়ে ভাবিত, তাই রাষ্ট্রের ভূমিকা, এর সম্ভাব্য বিবর্তন এবং এই প্রপঞ্চটির সাথে সংশ্লিষ্ট বা একে ভোল পাল্টাতে সাহায্য করার মতো ভাবাদর্শিক অনুমানসমূহ সম্পর্কে একেবারে প্রাথমিক কিছু পর্যবেক্ষণ আমি প্রণয়ন করতে চাই। এটা দিয়ে শুরু করা স্বাভাবিক যে, দুই ধরণের ক্ষমতা-ব্যবস্থা আমরা চিহ্নিত করতে পারি: রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। নীতিগত দিক থেকে প্রথমটা গড়ে ওঠে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে, যাঁরা জনজীবনের নীতিমালা নির্ধারণ করেন। আর পরেরটা, নীতিগত দিক থেকে, ব্যক্তিখাতের ক্ষমতার একটা ব্যবস্থা, জনগণের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত ব্যক্তিগত সাম্রাজ্যসমূহের একটা ব্যবস্থা। জনগণের এই নিয়ন্ত্রণ না-থাকার ব্যতিক্রমও ঘটে বটে, তা ঘটে দূরবর্তী এবং পরোক্ষ কিছু উপায়ে, যেসব উপায়ে এমনকি সামন্ত অভিজাত সম্প্রদায় বা সর্বাত্মক-স্বৈরাচারও জনগণের ইচ্ছার প্রতি সাড়া দিতে বাধ্য থাকে। সমাজের এই গঠন-প্রণালীর অনেকগুলো সরাসরি পরিণাম আছে।

প্রথমটা হচ্ছে এই যে, প্রচ্ছন্ন কিছু উপায়ে জনগণের ব্যপক অংশের মধ্যে সর্বাত্মক-স্বৈরাচারী একটা মানসগঠন সঞ্চারিত হয়ে যায়, যা ওপর থেকে আসা একনায়কসুলভ হুকুম মোতাবেক চলে। আমার মনে হয়, সংস্কৃতির সাধারণ চরিত্রের ওপর এর একটা বিশাল প্রভাব আছে: এতে করে এরকম একটা বিশ্বাস গড়ে ওঠে যে, সবারই উচিত একনায়কসুলভ হুকুম মেনে চলা এবং কর্তৃপক্ষের সাথে সম্মতি পোষণ করা। এবং আমার মনে হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোর যুব-আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটা সত্যিই উল্লেখযোগ্য ও উত্তেজনাকর একটা ব্যাপার যে, এই যুব-আন্দোলন কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে এবং কর্তৃত্ববাদী ছকগুলোকে ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করেছে।

দ্বিতীয় যে-ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, নীতিগত দিক থেকে যে-সিদ্ধান্তগুলো জনগণের গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে প্রণীত হওয়ার কথা, সে-ধরণের সিদ্ধান্তগুলোর আওতা খুবই সংকীর্ণ। যেমন ধরুন, যেকোনো অগ্রসর শিল্পায়িত সমাজের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ তথা বাণিজ্যিক, শিল্পভিত্তিক এবং আর্থিক পুরো ব্যবস্থাটাই আইনের দিক থেকে এবং নীতিগত দিক থেকে ঐ ধরণের সিদ্ধান্তসমূহের আওতার বাইরে থেকে যায়।

এবং তৃতীয় ঘটনাটা হচ্ছে, এমনকি যেসব ইস্যু নীতিগতভাবে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগ্রহণ-প্রক্রিয়ার অধীনেই রাখা হয়েছে, সে-সবের সংকীর্ণ চৌহদ্দীর ভেতরেও ব্যক্তিখাতের ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো নিঃসন্দেহে অতিরিক্ত রকমের বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। প্রভাব বিস্তার করা হয় এমন সব উপায়ে, যা এমনিতেই একেবারে ঠিকঠাকমতো বোঝা যায়: মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে, বা খোদ সংসদীয় ব্যবস্থার উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তা বসানোর মতো সরল ও সরাসরি উপায়ে, যা তাঁরা স্পষ্টতই করে থাকেন। যুদ্ধ-পরবর্তী জাতীয় নিরাপত্তা-ব্যবস্থার শীর্ষ পর্যায়ের ৪০০ সিদ্ধান্ত-প্রণেতার ওপর পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ডিক বার্নেট জানিয়েছেন:

 

সিদ্ধান্তপ্রণেতাদের বেশিরভাগই এসেছেন নির্বাহী কর্মকর্তাদের স্যুইট এবং আইনজীবীদের অফিসসমূহ থেকে, যেগুলো ৫টা বড় শহরের ১৫টা সিটি ব্লকে এমন দূরত্বে অবস্থিত যে, একটা থেকে চিৎকার করলে অন্যটা থেকে শোনা যায়।


এবং অন্য সকল গবেষণায়ও একই জিনিস দেখা যায়। সংক্ষেপে, পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে বড়জোর একটা সংকীর্ণ সীমার ভেতরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা কাজ করে। এমনকি এই সংকীর্ণ সীমার ভেতরেও এর কার্যক্রম বিপুলভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হয় ব্যক্তিখাতের ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের কারণে এবং কর্তৃত্বপরায়ন আর নিষ্ক্রিয় চিন্তা-প্রণালীর কারণে, যা সঞ্চারিত হয় যেমন ধরুন শিল্পকারাখানার মতো স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দিয়ে। এটা একটা সর্বজন-পরিজ্ঞাত সত্য যে, পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত একেবারেই সামঞ্জস্যহীন। সর্বজন-পরিজ্ঞাত হলেও এই সত্যটার ওপর ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বারোপ করে যাওয়া দরকার। আর, বিষয়টার প্রতি সতর্ক দৃষ্টিপাত করলে এই উপসংহারটাই স্রেফ আরও জোরদার হয়ে ওঠে বলে আমার ধারণা।

রাজনৈতিক এবং শিল্পকারখানাগত উভয় ব্যবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীভবন ঘটার নিঁখুত রকমের স্বতঃস্পষ্ট প্রক্রিয়াদি বর্তমান আছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা ধরলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের বছরগুলোতে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা সংসদীয় গণতন্ত্রেই (শুধু আমাদেরটা নয়) সংসদের ভূমিকা কমতেই আছে। এটা সবাই জানেন এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা উপর্যুপরি তা শনাক্তও করেছেন। অন্য কথায় বললে, রাষ্ট্রের পরিকল্পনা-প্রণয়ন-কার্যক্রম যতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, নির্বাহী বিভাগ ততোটাই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। সংসদের সশস্ত্রবাহিনী-কমিটি বছর দুয়েক আগে কংগ্রেসের ভূমিকা সম্পর্কে বলেছিল, কংগ্রেস কখনো-সখনো ঝগড়াঝাঁটি করে ঠিকই, কিন্তু আদতে তা সেই দয়ার্দ্র জ্যাঠামশায়ের মতো, যিনি রেগেমেগে ফোঁস ফোঁস করে পাইপ টানতে টানতে এটা-সেটা নালিশ তোলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত, সবাই যেমনটা আশা করেন, তিনি নতি স্বীকার করেন এবং অর্থ-বরাদ্দটা দিয়ে দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে সরকারের সামরিক সিদ্ধান্তসমূহ সংক্রান্ত সযত্ন গবেষণাবলী থেকে দেখা যায়, এই ধারণাটা একদম ঠিক। সিনেটর ভ্যানডেনবার্গ ২০ বছর আগে তাঁর এই ভীতি প্রকাশ করেছিলেন যে, মার্কিন দেশের প্রধান নির্বাহী ব্যক্তিটি হয়ত ‘‘বিশ্বের এক নম্বর যুদ্ধবাজ সামরিক নেতায়’’ পরিণত হবেন। তখন থেকে সেটাই ঘটে চলেছে। সবচাইতে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তটা হচ্ছে, নির্বাচকমন্ডলীর প্রকাশ্য আকাঙ্ক্ষাকে নৈরাশ্যজনকভাবে অসম্মানের মাধ্যমে ১৯৬৫-র ফেব্রুয়ারি মাসে ভিয়েতনামে যুদ্ধ ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত। যুদ্ধ ও শান্তি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসমূহের ব্যাপারে জনগণের ভূমিকা কেমন এবং জনস্বার্থ সংক্রান্ত নীতিমালার প্রধান ধারাগুলো সম্পর্কিত সিদ্ধান্তসমূহের ক্ষেত্রেই বা জনগণের ভুমিকা কেমন, তা এই ঘটনা নিখুঁত সুস্পষ্টতা সহকারে প্রকাশ করে বলে আমার মনে হয়। এবং জাতীয় নীতি সংক্রান্ত মূল মূল সিদ্ধান্তের সাথে যে নির্বাচনী রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তা-ও দেখিয়ে দেয় এই ঘটনা।

দুর্ভাগ্য হলো, এই সব পাজি লোকজনকে আপনারা ভোট দিয়ে বের করে দিতে পারেন না, কেননা আদি কথা হচ্ছে, আপনারা কখনোই তাদেরকে ভোট দিয়ে ঢোকান নি। [হর্ষধ্বনি ও করতালি]

রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একেবারে প্রধান অংশটাই হচ্ছে শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীর নির্বাহী, শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীর আইনজীবী এবং এরকম আরও আরও লোকজন। ক্রমবর্ধমান হারে এঁরা সাহায্য পান বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিচিত্র দুর্বোধ্য হর্তকর্তা-শ্রেণীর কাছ থেকে। আপনারা যাঁদেরকেই নির্বাচিত করেন না কেন, এই সমস্ত লোকজনই আসলে ক্ষমতায় থেকে যান। অধিকন্তু, এটা খেয়াল করাটা চিত্তাকর্ষক যে, এই শাসক-অভিজাতরা তাঁদের নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে রীতিমতো ওয়াকিবহাল।

উদাহরণ হিসেবে রবার্ট ম্যাকনামারার কথাই ধরুন, উদারনীতিবাদী পরিমন্ডলে যিনি তাঁর মানবিকতার জন্য, তাঁর কারিগরী উজ্জ্বলতার জন্য এবং তাঁর সামরিক-নিয়ন্ত্রণের প্রচারাভিযানের জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত। সামাজিক সংগঠন-বিন্যাস সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, আমার মনে হয়, খুবই আলোকসঞ্চারী। তিনি বলছেন, নীতি-নির্ধারণী বিষয়াদিতে তো বটেই, ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ব্যাপারটা থাকা উচিত একেবারে শীর্ষে, শীর্ষওয়ালারা আছেন কীসের জন্য, এবং আরও এগিয়ে গিয়ে তাঁর প্রস্তাব হচ্ছে, স্পষ্টতই এটা একটা ঐশ্বরিক অনুজ্ঞা। [হাসি] উদ্ধৃতি দিচ্ছি:

 

ঈশ্বর পরিষ্কারভাবেই গণতান্ত্রিক। মস্তিস্কের ক্ষমতা তিনি বিতরণ করেন সর্বজনীনভাবে, কিন্তু অত্যন্ত নায্যত তিনি প্রত্যাশা করেন যেন আমরা সেই অমূল্য উপহার দিয়ে সুদক্ষ ও গঠনমূলক কিছু একটা করি। ব্যবস্থাপনা বলতে মোটমাট যা বোঝায় তা এটুকুই। [হাসি] সমস্ত কলা-বিদ্যার মধ্যে শেষ অব্দি ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে সবচাইতে সৃজনশীল, কেননা এর মাধ্যম হচ্ছে মানবীয় প্রতিভা খোদ নিজে। গণতন্ত্রের প্রতি আসল হুমকিটা আসে ঊন-ব্যবস্থাপনা থেকে। একটা সমাজের ঊন-ব্যবস্থাপনা স্বাধীনতার জন্য সম্মানজনক নয়। এটা স্রেফ যুক্তি-বহির্ভূত কোনো শক্তিকে বাস্তবতা গড়ে তোলার সুযোগ করে দেওয়া। মানুষকে যা শাসন করবে তা যদি যুক্তি না হয়ে অন্য কিছু হয়, তাহলে মানুষের সুপ্ত শক্তি কমে যায়।


সুতরাং, ব্যবস্থাপকদের হাতে শীর্ষ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত প্রণয়নের কেন্দ্রীভবনকেই যুক্তি হিসেবে শনাক্ত করতে হয়। সিদ্ধান্ত প্রণয়নে লোক-সাধারণের অংশগ্রহণ স্বাধীনতার জন্য হুমকি, যুক্তির লঙ্ঘন। যুক্তি অঙ্গীভূত থাকে কঠোরভাবে ব্যবস্থাপিত স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহে। প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সুদক্ষভাবে মানুষ যেন কাজ চালাতে পারে, সেই জন্য সেগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তোলাটা তাঁর ভাষায় ‘‘আমাদের কালের মহা-মানবীয় অভিযাত্রা’’। এখন এই সমস্ত কিছুর ক্ষীয়মান ধরণের চেনাজানা একটা ঘণ্টা-ধ্বনি আছে। এবং এই ধ্বনিই হচ্ছে কারিগরি বুদ্ধিজীবী-সম্প্রদায়ের খাঁটি কণ্ঠস্বর; আধুনিক সমাজের কৃৎ-প্রকৌশলতান্ত্রিক কর্পোরেট-অভিজাতদের উদার-নীতিবাদী বুদ্ধিজীবী-সম্প্রদায়ের খাঁটি কণ্ঠস্বর।

কেন্দ্রীভবনের একটা সমান্তরাল প্রক্রিয়া চালু আছে অর্থনৈতিক জীবনে। সাম্প্রতিক একটা এফটিসি-রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সমস্ত শিল্প-উৎপাদন পরিসম্পদের তিন ভাগের প্রায় দুই ভাগই এখন নিয়ন্ত্রণ করে ২০০টি বৃহত্তম শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠী। [এফটিসি: ফেডারেল ট্রেড কমিশন] রিপোর্টটা থেকে আমি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। এটা বলছে:

 

অনেক বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানের একত্রীভবনের মাধ্যমে সৃষ্ট বিশালকায় কোম্পানিসমূহ থেকে উদ্ভুত ক্ষুদ্র একটা শিল্পপতি অভিজাত সম্প্রদায় মার্কিন ব্যবসা-খাতকে গবগব করে গিলে খাচ্ছে এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ স্বাধীন শিল্পোদ্যোগসমূহকে অনেকাংশে ধ্বংস করে দিচ্ছে।


শুধু তাই নয়, এটা আরও বলছে,
 

এই দুই শ শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠী পরস্পরের সাথে এবং অন্যান্য শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীর সাথে এমন সব কায়দায় সংযুক্ত, যা বাজার সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসমূহের ক্ষেত্রে স্বাধীন আচার-ব্যবহারকে বাধা দিতে পারে বা নিরুৎসাহিত করতে পারে।


এই ধরণের পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে যেটা অভিনব, সেটা হলো এদের উৎস: এফটিসি। মার্কিন সমাজের বাম-উদারনীতিবাদী ভাষ্যকারদের মধ্যে এগুলো পরিচিত হতে হতে পচে গেছে প্রায়।

ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের একটা আন্তর্জাতিক মাত্রাও আছে। সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, ফরেন অ্যাফেয়ার্স জার্নাল থেকে আমি উদ্ধৃতি দিচ্ছি,

 

শিল্পোৎপাদনের মোট পরিমাণের সার্বিক মূল্যের ভিত্তিতে বিদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যাবতীয় শিল্পোদ্যোগ মিলিয়ে ধরলে, তা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হয়ে দাঁড়ায়-এর মোট উৎপাদনের পরিমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন বাদ দিলে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। ইংল্যান্ডের গাড়ি-শিল্পের অর্ধেকটা, জার্মানীর জ্বালানী তেলের ৪০%, ফ্রান্সের টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, ইলেকট্রিক এবং ব্যবসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির ৪০% এরও বেশি এবং কম্পিউটার ইত্যাদির ৭৫% নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন প্রতিষ্ঠানাদি। বর্তমান প্রবণতা বজায় থাকলে এক দশকের মধ্যেই বৃটিশ রপ্তানি-দ্রব্যের অর্ধেকেরও বেশি যাবে মার্কিন মালিকানাধীন কোম্পানিসমূহ থেকে।


অধিকন্তু, এগুলো হচ্ছে উচ্চ মাত্রায় কেন্দ্রীভূত বিনিয়োগ: জার্মানি, ফ্রান্স আর বৃটেনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ৪০% মাত্র তিনটা প্রতিষ্ঠানের, মার্কিন প্রতিষ্ঠান।

জর্জ বল ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মার্কিন পুঁজির আধিপত্যের নিচে সমন্বিত একটা বিশ্ব-অর্থনীতি, অন্য কথায় একটা সাম্রাজ্য, গড়ে তোলার প্রকল্প অলসভাবে পাইপ টানতে টানতে দেখা কোনো স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা-সম্পন্ন ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি বলছেন, আমাদের নিজেদের আর্থনীতিক গতিপ্রবণতাই আমাদেরকে এমন একটা ভূমিকার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এ-কাজে প্রধান হাতিয়ারটাই হচ্ছে বহুজাতিক শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠী, যাকে জর্জ বল বর্ণনা করেন এভাবে:

 

আধুনিক রূপকাঠামোধারী যে-বহুজাতিক শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠী, অর্থাৎ যে-বহুজাতিক শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীর বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম ও বাজার আছে, সেটা সুস্পষ্টভাবেই একটা মার্কিন বিকাশ। এ-ধরণের শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দুনিয়ার সব সম্পদ সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে, কিন্তু বহুজাতিক শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীর সুবিধাদিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্য বিশ্ব-অর্থনীতির বৃহত্তর একত্রীভবন দরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের জোগাড় করা ধনসম্পদের সুবিধাভোগী হচ্ছে এই বহুজাতিক শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠী এবং এদের দুনিয়াজোড়া কার্যক্রম ও বাজার শেষ পর্যন্ত মার্কিন সামরিক বাহিনীর পাহারাতেই থাকে, যার ঘাঁটি এখন ডজন ডজন দেশে। সমন্বিত যে-বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এইসব মার্কিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের রাজত্ব, সেই অর্থনীতি থেকে কারা সুবিধা তুলে নেবে তা অনুমান করা কঠিন না।


আচ্ছা, ভালো কথা, আলোচনার এই পর্যায়ে কমিউনিজমের ভূতের কথাটা তোলা দরকার। এই ব্যবস্থার দিকে কমিউনিজমের হুমকিটা কী রকম? সুস্পষ্ট ও অকাট্য উত্তর পাওয়ার জন্য উড্রো উইলসন ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় পরিকল্পনা সমিতির একটা সুবিস্তৃত গবেষণার দারস্থ হতে পারেন, যার নাম মার্কিন বৈদেশিক নীতির রাজনৈতিক অর্থনীতি, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বই। কাগজে-কলমে যাঁরাই ক্ষমতায় থাকুন না কেন, তাঁদের পক্ষে যে-ক্ষুদ্র অভিজাত গোষ্ঠীটি অনেকাংশে জনসাধারণ সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁদের প্রতিনিধিমূলক অংশের দ্বারা এই বইটা সংকলিত হয়েছিল। কার্যত, মার্কিন শাসকশ্রেণীর একটা ইশতেহার যদি আপনি পেতে পারতেন, এটা প্রায় সেরকমই একটা ব্যাপার। এতে কমিউনিজমের প্রধান হুমকিকে তারা সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘‘কমিউনিস্ট শক্তিগুলোর এমন ধরণের অর্থনৈতিক রূপান্তর’’ হিসেবে, ‘‘যা পশ্চিমের শিল্পকেন্দ্রিক অর্থনীতিসমূহকে পরিপূরণ করার ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছা বা সক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়’’। এই হচ্ছে কমিউনিজমের প্রধান হুমকি। সংক্ষেপে বললে, বিশ্ব পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ফিলিপাইন যেভাবে কাজ করে-৭৫ বছরের মার্কিন অভিভাবকত্বে ও আধিপত্যে যে-ফিলিপাইন ধ্রুপদী ধরণের ঔপনিবেশিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়েছে-সেভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে অনুন্নত দেশগুলোর সদিচ্ছা ও সক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় কমিউনিজম। এই হলো সেই মতধারা, যা থেকে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কেন বৃটিশ অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসন কমিউনিজমের বিরুদ্ধে মার্কিন ক্রুসেডকে উন্নয়নের বিরুদ্ধে ক্রুসেড হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দীর্ঘদিনের এই সাম্রাজ্যিক উদ্যোগের বিশেষ একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তে এসে সহায়-সমর্থন জোগাড়-যন্ত্র করার কাজে মূলত একটা প্রচারণা-ফন্দি হিসেবে শীতল-যুদ্ধের ভাবাদর্শ আর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র কাজ করে থাকে। আসলে, আমার বিশ্বাস, এটাই সম্ভবত শীতল যুদ্ধের প্রধান কাজ। মার্কিন সমাজের ব্যবস্থাপকদের এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে তাদের সমজাতীয় লোকজনের পক্ষে তাঁদের নিজ নিজ দেশের জনসমষ্টিসমূহকে এবং নিজ নিজ সাম্রাজ্য-ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে এটা একটা কার্যকর কৌশল হিসেবে কাজ করে। বিশাল দুই বিশ্ব-ব্যবস্থার ম্যানেজারদের কাছে শীতল-যুদ্ধের যে-উপযোগিতা, তা দিয়েই এর টিকে থাকার ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যায় বলে আমার ধারণা।

বেশ, শেষ একটা উপাদান বাকি থাকল, যা এই ছবিটার সাথে যোগ করতে হবে, সেটা হলো মার্কিন সমাজের চলমান সামরিকায়ন। কীভাবে এটা আসে? তা দেখতে হলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ফিরে তাকাতে হবে এবং স্মরণ করতে হবে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আমরা গভীর মন্দায় ছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছিল। এটা শিক্ষা দিয়েছিল যে, সযত্নে নিয়ন্ত্রিত-কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত- একটা অর্থনীতিতে সরকার-সঞ্চালিত উৎপাদন মন্দার অভিঘাতকে কাটিয়ে উঠতে পারে। আমার মনে হয়, ১৯৪৪-এর শেষে চার্লস ই. উইলসন যখন বলেছিলেন যে, যুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে আমাদের অর্থনীতিটা হবে চিরস্থায়ী যুদ্ধের অর্থনীতি, তখন তার মনে ঐ কথাটাই ছিল। হ্যাঁ, সমস্যা অবশ্যই এই যে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মাত্র কয়েকটা পথই আছে যাতে করে সরকারী হস্তক্ষেপ ঘটতে পারে। যেমন ধরুন, ব্যক্তিখাতের সাম্রাজ্যগুলোর সাথে তো সরকার প্রতিযোগিতায় নামতে পারে না, অর্থাৎ তাতে করে কোনো ব্যবহারোপযোগী উৎপাদন সম্ভব হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, উৎপাদনটা হতে হবে বিলাসদ্রব্যের। পুঁজি না, কাজের কোনো পণ্য না-দ্রব্য, প্রতিযোগিতা করার মতো দ্রব্য। এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাত্র এক পদের বিলাসদ্রব্যই আছে, যা উৎপাদন করা যায় অফুরানভাবে, আর অকেজো হয়ে পড়ার কারণে যা পুরনো হয়ে যায় খুবই তাড়াতাড়ি, এবং তার কতগুলোকে আপনি ব্যবহার করতে পারবেন তার কোনো সীমা-সংখ্যা নাই। আমরা সবাই জানি সেটা কী।

এই পুরো ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবে বর্ণনা করেছেন ব্যবসায়ের ইতিহাস-প্রণেতা আলফ্রেড চ্যান্ডলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক শিক্ষার বিবরণ তিনি এভাবে দিয়েছেন:

 

সবচাইতে উৎসাহী নব্য ব্যবসায়ীটিও কখনোই যতটা প্রস্তাব করে নি, সরকার তার চেয়ে ঢের বেশি টাকা খরচ করেছিল। এইসব খরচের ফলে উৎপন্ন দ্রব্যাদির বেশিরভাগটাই হয় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল, না হয়তো ফেলে রাখা হয়েছিল ইউরোপ আর এশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে। কিন্তু তার থেকে যে-বর্ধিত চাহিদা তৈরি হয়েছিল, জাতিকে তা পৌঁছে দিয়েছিল এমন একটা উন্নতির যুগে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। শুধু তাই না, আগে-পরে সকল সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা লড়ার জন্য বিপুল আয়তনের সশস্ত্র বাহিনী আর নৌবাহিনীর সরবরাহ যুগিয়ে চলতে প্রয়োজন পড়েছিল জাতীয় অর্থনীতির ওপর কঠোরভাবে কেন্দ্রায়িত নিয়ন্ত্রণের। এই প্রয়াসই শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীর ম্যানেজারদেরকে ওয়াশিংটনে এনে জড়ো করেছিলো ইতিহাসের সবচে জটিল অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোর একটাকে বাস্তবায়ন করার কাজে। এই অভিজ্ঞতা অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা সংক্রান্ত ভাবাদর্শগত ভয়ভীতিকে কমিয়ে দিয়েছিল।


আগেই আমি বলে রাখতে পারতাম যে, ইনি একজন রক্ষণশীল ভাষ্যকার। এ-কথাও যোগ করা চলে যে, মার্কিন সমাজের বিরাজনীতিকীকরণকে আরো এগিয়ে নিয়ে গেছে ঘটনার পরিণামে সৃষ্ট শীতল-যুদ্ধ এবং তা সৃষ্টি করেছে এমন ধরণের মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ, যাতে করে সরকার হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হয়। এ-হস্তক্ষেপ করা হয়ে থাকে অংশত নীতিমালার মাধ্যমে এবং অংশত সরকারী বিভিন্ন দপ্তরের সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা সম্প্রসারণ, পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ও নানাবিধ পাবলিক সার্ভিসের মাধ্যমে। কিন্তু অত্যন্ত ব্যাপক হস্তক্ষেপ করা হয়ে থাকে নিঃসন্দেহে প্রতিরক্ষা-ব্যয়ের মাধ্যমে।

এই পদ্ধতিতে আলফ্রেড চ্যান্ডলারের ভাষায়, ‘‘ম্যানেজাররা যখন উচ্চ মাত্রার সামষ্টিক চাহিদা বজায় রাখতে পারে না, শেষ আশ্রয় হিসেবে সরকার তখন সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করে।’’ ব্যবসায়-ইতিহাসের অন্য একজন রক্ষণশীল রচয়িতা জোসেফ মনসন লিখছেন,

 

অর্থনীতিতে সরকারী হস্তক্ষেপের কারণে ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীর আলোকায়িত ম্যানেজাররা নতুন অর্থনীতিকে বরং শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীর টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখেন।


এইসব ধ্যানধারণার সবচেয়ে নৈরাশ্যজনক প্রয়োগ ঘটান সরকারী ভর্তুকিপ্রাপ্ত যুদ্ধশিল্পের ম্যানেজাররা। বছরখানেক আগে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় এ-সম্পর্কে বার্নার্ড নোসিটারের একটা ধারাবাহিক রচনা এসেছিল। উদাহরণ হিসেবে তিনি এলটিভি অ্যারোস্পেসের ফিন্যান্সিয়াল ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যামুয়েল ডাউনারের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি নতুন বৃহৎ মহাশিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীগুলোর অন্যতম। ডাউনার বুঝিয়ে বলছিলেন কেন যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বকে সামরিক ব্যবস্থাদি দিয়ে চাঙ্গা করে রাখতেই হবে। তিনি বলছিলেন, ‘‘এটা একেবারে বুনিয়াদি ব্যাপার।’’
 

এর বিক্রয়-যোগ্যতাটাই হচ্ছে দেশের প্রতিরক্ষা। সিস্টেমটাকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য রাজনীতিবিদরা সবচেয়ে বড় যেসব আবেদন কাজে লাগাতে পারেন, এটা তাদের মধ্যে একটা। আপনি যদি রাষ্ট্রপ্রধান হন এবং অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার মতো একটা উপাদান যদি আপনার দরকার পড়ে, এবং এই উপাদানটা আপনি যদি বিক্রিও করতে চান, তাহলে আপনি হারলেম অ্যান্ড ওয়াট্স্-কে তো আর বেচতে পারেন না, কিন্তু আপনি আত্ম-সুরক্ষার ব্যাপারটাকে বেচতে পারেন। এটা একটা নতুন পরিবেশ। যতক্ষণ পর্যন্ত রাশিয়ার ঐ জারজরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে, আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতেই থাকব। মার্কিন জনসাধারণ এটা বোঝে।


এই মারাত্মক ও নৈরাশ্যকর খেলায় ঐ জারজরা আমাদের চেয়ে যথার্থভাবে অবশ্যই এগিয়ে নেই, কিন্তু সেটা এই তত্ত্বের জন্য সামান্য একটু অস্বস্তি মাত্র। প্রয়োজনের সময় সর্বদাই আমরা অনুসরণ করতে পারি ডিন রাস্ক, হুবার্ট হামফ্রে এবং অন্য সব উজ্জ্বল নক্ষত্রকে এবং আবেদন করতে পারি পুরোপুরি অস্ত্রসজ্জিত শত কোটি চীনার কাছে এবং বেরিয়ে পড়তে পারি বিশ্ব বিজয়ে। [হাসি]

নিজের দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা কৌশল হিসেবে শীতল-যুদ্ধ যে এই সিস্টেমটার মধ্যে ভূমিকা পালন করে, আবার আমি তার উপর জোর দিতে চাই। এটা এমন একটা কৌশল, যা কাজে খাটানো হয় মানসিক ভ্রম ও মনোবৈক্যল্যের একটা মনস্তাত্ত্বিক আবহাওয়া গড়ে তোলার লক্ষ্যে। এই আবহাওয়ায় ক্রমবর্ধমান হারে কেন্দ্রায়িত হতে থাকা বর্তমান সিস্টেমটিতে আধিপত্যকারী মার্কিন শিল্পকারখানা এবং শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীসমূহের প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে অগ্রসর খাতগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণে এবং অফুরানভাবে ভর্তুকি দিতে থাকার জন্য করদাতারা ইচ্ছুক থাকবে।

ভালো কথা, রুশ সাম্রাজ্যবাদ যে মার্কিন ভাবাদর্শ-বিশারদদের কোনো উদ্ভাবন নয়, সেটা নির্ভুলভাবে স্পষ্ট। যেমন ধরুন, হাঙ্গেরীয়দের জন্য এবং চেকদের জন্য এটা যথেষ্ট বাস্তব একটা ব্যাপার। তবে, রুশ সাম্রাজ্যবাদকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, সেটা একটা উদ্ভাবন বটে। যেমন ধরুন, ১৯৫০ সালে ডিন অ্যাচেসন বা তার এক দশক পরে ওয়াল্ট রস্টো যেভাবে এটা ব্যবহার করেছিলেন। তাঁরা ভান করছিলেন যে, ভিয়েতনাম-যুদ্ধ রুশ সাম্রাজ্যবাদের একটা দৃষ্টান্ত। অথবা ১৯৬৫ সালে জনসন-প্রশাসনের কথা ধরুন। চীন-সোভিয়েত সামরিক ব্লকের দোহাই দিয়ে তিনি ডোমিনিকান রিপাবলিকের ওপর হস্তক্ষেপের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। অথবা কেনেডি-বুদ্ধিজীবীদের কথা ধরুন, যাঁরা ‘‘শীতল যুদ্ধের বছরগুলোর টানাপোড়েনে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন এবং অনুধাবন করতে পারেননি যে, ভিয়েতনামের জাতীয় বিপ্লবের বিজয় হলে সেটা মস্কো বা পিকিঙের বিজয় হতো না’’-টাউনসেন্ড হুপস কথাটা লিখেছেন গতমাসের ওয়াশিংটন মান্থলি পত্রিকায়। সর্বজনমান্য শিক্ষিত লোকজনের পক্ষে এটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রার বিভ্রান্তি বটে। অথবা ইউজিন রস্টোর কথাই ধরুন, যিনি সাম্প্রতিক এক বইয়ে (যে-বই উদারনীতিবাদী সিনেটরবৃন্দ আর বিদ্যায়তনিক বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা খুবই ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল) আধুনিক যুগের বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জসমূহের ধারাক্রমটির রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন এভাবে: ‘‘নেপোলিয়ন, কাইজার ভিল্হেল্ম্, হিটলার’’, এবং যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে এসে, ‘‘ফ্রান্স আর ইতালির সাধারণ ধর্মঘটসমূহ, গ্রিসের গৃহযুদ্ধ এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের উপর আক্রমণ’’। ১৯৬৮ সালে তিনি লিখছেন, ভিয়েতনামে ‘‘তলোয়ারের দ্বারা কমিউনিজম বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে রাশিয়া আমাদেরকে কঠোর পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে’’।

এখন, বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জসমূহের এটা খুবই চিত্তাকর্ষক একটা ধারাক্রম: নেপোলিয়ন, কাইজার ভিল্হেল্ম্, হিটলার, ফ্রান্স আর ইতালির সাধারণ ধর্মঘটসমূহ, গ্রিসের গৃহযুদ্ধ এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের উপর রুশ হামলা। কেউ যদি এটা নিয়ে আগাগোড়া চিন্তা করেন, তাহলে আধুনিক ইতিহাস সম্পর্কে তিনি বেশ আগ্রহ জাগানোর মতো কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবেন।

আচ্ছা, এটা নিয়ে অনির্দিষ্টভাবে বলেই চলা যায়। বলতে চাচ্ছি, আমার প্রস্তাব হলো, শীতল-যুদ্ধ খুবই উচ্চ মাত্রায় ব্যবহারিক একটা জিনিস-মার্কিন অভিজাত শ্রেণীর কাছেও বটে, তাঁদের সোভিয়েত প্রতিপক্ষের কাছেও বটে। চেকোস্লোভাকিয়ায় সেনা পাঠানোর সময় সোভিয়েতরাও নিখুঁতভাবে একই পদ্ধতিতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে নিজেদের কাজে লাগায় (পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদও কিন্তু তাঁদের উদ্ভাবিত বস্ত্ত ছিল না)। উভয় ক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যের জন্য ভাবাদর্শ জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং এখানকার সামরিক পুঁজিবাদের ভর্তুকিপ্রাপ্ত সিস্টেমটির জন্য ভাবাদর্শ জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা তাহলে আগে থেকেই বলে দেওয়া সম্ভব যে, এই ভাবাদর্শটির প্রতি চ্যালেঞ্জ আসলে তা তিক্তভাবে প্রতিরোধ করা হবে, দরকার হলে গায়ের জোরে। অনেক দিক দিয়েই মার্কিন সমাজ সত্যিই খোলামেলা এবং উদারনীতিবাদী মূল্যবোধসমূহ এখানে সংরক্ষিত হয়। উদারনীতিবাদী প্রলেপটা অবশ্য বেশ পাতলা, যা গরিব মানুষ আর কালো মানুষ আর অপরাপর জাতিগত সংখ্যালঘুরা খুব ভালো করেই জানেন। মার্ক টোয়েন একবার লিখেছিলেন,

 

ঈশ্বরের কৃপায় আমাদের দেশে তিনটা অনির্বচনীয় রকমের মূল্যবান জিনিস আমাদের আছে: বাকস্বাধীনতা, বিবেকের স্বাধীনতা আর এদের কোনোটাকেই অনুশীলন না করার মতো দূরদর্শিতা। [হাসি]


এই দূরদর্শিতার অভাব যাদের আছে, নিঃসন্দেহে তাঁদেরকে তার মূল্য দিতে হবে।

মোটামুটিভাবে বললে, আমার মনে হয় এটা বলা যথার্থ হবে যে, ম্যানেজার আর মালিকদের একটা শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীগত অভিজাত শ্রেণী অর্থনীতিকে তো অবশ্যই, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও শাসন করে, অন্তত ব্যাপক অংশে তো বটেই। মার্কস যাঁদেরকে একবার ‘‘শাসকশ্রেণীর মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বী উপদল আর অভিযাত্রীবৃন্দ’’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, তাঁদের মধ্য থেকে লোক বেছে নেওয়ার সুযোগ তথাকথিত জনসাধারণ মাঝেমধ্যে পায় বৈকি। আর যাঁরা এরকমভাবে চরিত্রায়ন করাকে অতি-কঠোর বলে মনে করেন, তাঁরা হয়ত জোসেফ শুম্পিটারের মতো আধুনিক গণতান্ত্রিক একজন তাত্ত্বিকের সূত্রায়নকে পছন্দ করতে পারেন। শুম্পিটার আধুনিক রাজনৈতিক গণতন্ত্রকে, এর অনুকূলেই বটে, আখ্যায়িত করেছেন

 

এমন একটা ব্যবস্থা হিসেবে, যে-ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত-প্রণয়ন করা যাঁদের শোভা পায়, সেই ব্যক্তিবর্গকে নির্বাচন করাটাই নির্বাচনমন্ডলীর আসল কাজ, এবং কোন কোন ইস্যুতে সিদ্ধান্তগ্রহণ করা হবে, না-হবে, সেই ইস্যুগুলো নির্ধারণ করাটা নির্বাচকমন্ডলীর গৌণ কাজ মাত্র।


তিনি বলছেন, যথার্থভাবেই বটে,
 

রাজনৈতিক দলসমূহ হচ্ছে এমন একটা গোষ্ঠী, যার সদস্যরা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত প্রতিযোগিতাপূর্ণ সংগ্রামে সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রস্তাব পেশ করে। তা যদি না হতো, তাহলে আলাদা আলাদা পার্টির পক্ষে হুবহু একই বা প্রায় একই রকম কর্মসূচি গ্রহণ করাটা সম্ভব হতো না।


যেভাবে তিনি ব্যাপারটাকে দেখেন, তাতে করে রাজনৈতিক গণতন্ত্রের মোট সুবিধা বলতে এ-ই।

এই যে কর্মসূচি, কমবেশি উভয় পার্টিই যা হুবহু গ্রহণ করে, আর এই যে ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা করেন-এঁরা মিলেঝুলে সংকীর্ণ একটা রক্ষণশীল ভাবাদর্শের প্রকাশ ঘটান। এই ভাবাদর্শ বলতে মূলত শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীগত অভিজাত শ্রেণীর এই অংশ বা ঐ অংশের স্বার্থকে বোঝায়-কিছুটা অদলবদল করে নেওয়া হয় আর কি। এখন, এটা কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্র না। আমার মনে হয়, শিল্পবাণিজ্যগোষ্ঠীগত পুঁজিবাদের মধ্যেই এটা নিহিত থাকে। এইসব লোকজন এবং তাঁদের প্রতিনিধিত্ব-করা প্রতিষ্ঠানসমূহই কার্যত ক্ষমতায় থাকে, আর এঁদের স্বার্থই হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। এই হচ্ছে সেই স্বার্থ, সাগরপারের সাম্রাজ্য আর স্বদেশের সামরিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের বর্ধিষ্ণু সিস্টেম যাকে প্রধানত-এবং অভিভূত করে ফেলার মতো মাত্রায়-রক্ষা করে থাকে।

আমরা যদি শাসিতের সম্মতি প্রত্যাহার করে নিতাম। আমার মনে হয় আমাদের তা করা উচিত। আমাদের সম্মতি আমরা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। আমরা চাই না, এই সব লোকজন আর তাঁদের প্রতিনিধিত্ব-করা স্বার্থসমূহ মার্কিন সমাজকে শাসন করুক, পরিচালনা করুক। আমরা চাই না, বিশ্ব-ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের ধ্যানধারণাকে-এবং বৈধ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে তাঁদের নিজেদের মানদন্ডকে-তাঁরা বিশ্বের অধিকাংশ স্থান জুড়ে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিক। যদিও এসব সত্যকে লুকানোর জন্য প্রচারণা আর রহস্য-প্রণয়নের বিপুল কর্মপ্রয়াস চালানো হয়ে থাকে, সত্য তবু সত্যই থেকে যায়।

মানুষের প্রাণীগত চাহিদা মেটানোর মতো কারিগরি ও বস্ত্তগত সহায়-সম্পদ আজ আমাদের আছে। কিন্তু আমাদের এই বস্ত্তগত সম্পদ আর ক্ষমতাকে মানবিক এবং যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করতে পারার মতো সাংস্কৃতিক আর নৈতিক সহায়-সম্পদ, বা সামাজিক সংগঠনের গণতান্ত্রিক কাঠামো, আমরা গড়ে তুলিনি। এ-কথা বিশ্বাসযোগ্য যে, মুক্তিপরায়ন সমাজতন্ত্রের আদলে প্রকাশিত ও বিকশিত ধ্রুপদী উদারনীতিবাদী ভাবাদর্শগুলো অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু যদি তাই হয়, তবে তা হতে হবে শুধুমাত্র জনপ্রিয় বিপ্লবী আন্দোলনের দ্বারা। সে-আন্দোলন ব্যাপকভাবে প্রোথিত থাকবে জনসাধারণের পরতে-পরতে। আর, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের নিপীড়ক ও কর্তৃত্বপরায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্ছেদ করার জন্য সে-আন্দোলন থাকবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ-রকম একটা আন্দোলন সৃষ্টি করাটাই হলো গিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ, যা আমাদেকে মোকাবেলা করতে হবে। এবং অবশ্য অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জ আমাদেরকে পূরণ করতে হবে-সমকালীন বর্বরতার খপ্পর থেকে যদি আমাদের উদ্ধার পেতে হয়।

 


ভাষান্তর: রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার, নভেম্বর ১৪-২৮, ২০০৭
ঘষামাজা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৮



অনুবাদকের নোট


অডিও এবং শ্রুতিলিপির উৎস


নোম চমস্কির এই বক্তৃতাটির অডিও ফাইল পাওয়া যাবে এখানে: http://www.chomsky.info/audionvideo/19700216.mp3। এটির পূর্ণ ইংরেজি শ্রুতলিপি অনলাইন থেকে জোগাড় করেছিলাম: tangibleinfo.blogspot.com/2006/11/noam-chomsky-lecture-from-1970-full.html। শ্রুতলিপিটি ওয়েবসাইটটিতে পোস্ট করা হয়েছিল ২০০৬ সালের ২১শে নভেম্বর, মঙ্গলবার। শ্রুতলিপিটি কে প্রস্তুত করেছেন তা জানা যায়নি।


তৃতীয় বন্ধনী প্রসঙ্গে


এই বঙ্গানুবাদে তৃতীয় বন্ধনীর ভেতরের কথাগুলো অনুবাদকের, যেমন ‘‘লেনিন যাকে শিশুসুলভ অতি-বামপন্থা [মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের বঙ্গানুবাদে ‘বামপন্থী শিশুরোগ’] বলে আখ্যায়িত করেছিলেন’’। শুধু একটি জায়গায় ব্যতিক্রম ঘটেছে, যেখানে তৃতীয় বন্ধনীর ভেতরকার কথাগুলো চমস্কির বক্তৃতার শ্রুতিলিপি প্রস্ত্ততকারীর, যথা ‘‘সম্মিলিত প্রকৌশল ফেডারেশন [সম্ভবত ‘সম্মিলিত প্রকৌশল ইউনিয়ন’], আমার মনে হয় এটা ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন’’।


প্রথম প্রকাশের হদিস


মাওরুম, ঢাকা, দীপায়ন খীসা কর্তৃক সম্পাদিত এবং হিল রিসার্চ এন্ড প্রোটেকশন ফোরাম কর্তৃক প্রকাশিত, সংখ্যা ১৫, মে ২০০৯।

 

 

 
 
 
 
 
Logo