English | বাংলা
Logo
 

 

রাজশাহীতে খুন হওয়াটা মনে হয় ভিক্টিমদেরই অভ্যাস

এনটিভি অনলাইন, ২৪-০৪-২০১৬


আমাদের ভিক্টিম, অন্যদের ভিক্টিম

আমাদের রাষ্ট্রটা তো চালায় শিক্ষিত শ্রেণির লোকেরা। শিক্ষিত শ্রেণির লোকেদের ভেতরে যখন কেউ মারা যান, খুন হন; তখন আমরা সেটা নিয়ে অনেক বেশি বিচলিত হই। যখন কোনো কৃষক কোথাও খুন হয়ে যান, সেটা নিয়ে আমরা বিচলিত হই না। রাজশাহী শহরে এরই মধ্যে একটা হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রীকে খুন করা হয়েছে। সেটা নিয়ে আমরা অত আলাপ করার সুযোগ পাচ্ছি না। দুই-একদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়েছে। সেটা নিয়ে আমরা আলাপ করছি না। আমরা হত্যাকাণ্ডগুলোকে বাছাই করি: কোনটা আমাদের ভিক্টিম, কোনটা অন্যদের ভিক্টিম। ভিক্টিমের ‘মেরিট’ বিবেচনা করে আমরা বিচলিত হই, অথবা বিচলিত হই না। (০০:০১:০০ – ০০:০২:০০)
 

আমাদের এখন খোদ খুন নিয়ে আলাপ করা দরকার

কিন্তু আমার বিবেচনায় খোদ খুন জিনিসটা কেন হয়, এর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কারণগুলো কি কি– সেই জায়গাটাতে আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার। খোদ খুন জিনিসটা কি বাংলাদেশে আসলে অবৈধ? বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং তার বলপ্রয়োগকারী, আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তো মানুষ খুন করে চলেছেন। বিচার-বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড এখানে বিপুল পরিমাণে হচ্ছে। এখানে ক্রসফায়ার হচ্ছে, মানুষ দিন-দুপুরে হাওয়া হয়ে যাচ্ছেন, অজস্র মানুষ হারিয়ে যাচ্ছেন; এঁদের লাশ কোথাও পাওয়া যাচ্ছে, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। সারা বাংলাদেশে ৩৬৫ দিনই কোথাও না কোথাও খুন হচ্ছে। এই যাবতীয় খুন নিয়ে আমরা সার্বিকভাবে ভাবতে রাজি না। যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খুন হচ্ছেন বা কোনো লেখক খুন হচ্ছেন তখন আমরা বিচলিত হচ্ছি। এবং তখন আমরা আগে থেকেই উত্তর ঠিক করে রাখছি যে, এটা ‘জঙ্গি’দের কাজ। কিন্তু এরকমভাবে পুলিশ, সরকারি কর্তৃপক্ষ, মিডিয়া এমনকি সাধারণ মানুষ সবাই মিলে যখন একটা মুখস্থ পূর্বানুমান আগে থেকে ঠিক করে রেখে আলাপ শুরু করেন, তখন আমরা খোদ খুন একটা বিপজ্জনক জিনিস কি না, সেটা নিয়ে আর আলাপ করার সুযোগ পাই না। আমাদের এখন খোদ খুন নিয়ে আলাপ করা দরকার। (০০:০২:০০ – ০০:০৩:৪০)
 

আইন-আদালত দিয়ে খুন বন্ধ করা যায় না

বিচার করলে, বিচারের সংস্কৃতি দাঁড় করাতে পারলে খুন বন্ধ হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার-ব্যবস্থা আমাদের মতো খারাপ না, অত্যন্ত ভালো। সেই বিচার-ব্যবস্থাধীন দেশেও প্রচুর খুন হয়। পৃথিবীর অনেক দেশের চাইতেই সেখানে অনেক বেশি খুন হয়, বেশি রেপ হয়, কালোমানুষদের ওপর অত্যাচার অনেক বেশি চলে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জেলখানা পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে বেশি। তার মানে অনেক জেলখানা, অনেক বিচার, অনেক পুলিশ, অনেক আইন-আদালত দিয়ে খুন ঠেকানো যায় না। (০০:০৩:৪১ – ০০:০৪:১৬)
 

রাষ্ট্রের হাতে খুনের তালিকা অনেক বড়

প্রকৃতপক্ষে বর্তমান পৃথিবীর রাষ্ট্রীয়-বিরাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলোর ভেতরে সবচাইতে বড়ো খুনি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রাষ্ট্র। সে আইনগত বিচারের মধ্য দিয়েও খুন করে, আইনবহির্ভূতভাবে নিজস্ব এজেন্সি ব্যবহার করেও খুন করে। বাংলাদেশে তথাকথিত ‘জঙ্গি’দের হাতে (তাঁদের আমরা চিনি না, শুধু কর্মকর্তাদের মুখেই শুনি) খুন হয়েছেন গত ৪০ বছরে কত জন? আর, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বন্দুকধারী বাহিনীগুলোর হাতে (তাঁরা কখনো স্বীকার করেন, কখনো স্বীকার করেন না) এরকম কত মানুষ খুন হয়েছেন? রাষ্ট্রের হাতে খুনের তালিকা অনেক বেশি বড়। (০০:০৪:১৭ – ০০:০৫:০৩)
 

এই অতি সম্প্রতি যে যুগ গেলো, যে কাল যাচ্ছে; সেখানে আওয়ামী লীগের এই যে গত ৫ই জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন; সেই নির্বাচনকে ঠেকানো না ঠেকানো নিয়ে প্রচুর মানুষ সরকারি বাহিনীর হাতে খুন হয়েছেন। আবার যাঁরা পেট্রোল বোমা মেরেছেন, নানান ধরনের বোমাবাজি করেছেন; তাঁদের হাতেও অনেক মানুষ খুন হয়েছেন। এখন বোমাবাজি কারা করছেন, পেট্রোলবোমা কারা মারছেন আর চাপাতি দিয়ে কারা খুন করছেন; এগুলো মানুষের সামনে বিপুল তথ্যপ্রমাণসহ তুলে ধরার দায়িত্ব সরকারের। সরকার সেটা যদি না করেন, তাহলে বুঝতে হবে যে, সেটা না করার মধ্যে সরকারের কিছু উপকার নিহিত আছে। (০০:০৫:০৪ – ০০:০৫:৫০)
 

সুতরাং এটা খুব পরিষ্কার যে, খুনখারাবি এগুলো কারা করে। এগুলো কোনো না কোনো রকমের শক্তিশালী, পাওয়ারফুল লোকজন, গ্রুপ, প্রতিষ্ঠান করেন – তারাই খুনখারাবিগুলো করেন। যেকোনো রকমেরই হোক। এই যে বিভিন্ন রকমের পাওয়ারফুল গ্রুপস-ইনস্টিটিউশনস-এজেন্সিজ – গভর্মেন্ট অথবা ননগভর্মেন্ট – এই সংস্থাগুলো, প্রতিষ্ঠানগুলো যে খুন করে চলেছেন সেটা নিয়ে কিন্তু আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। আমরা শুধুমাত্র ‘জঙ্গি’দের দিকে তাকাচ্ছি। এখন কে ‘জঙ্গি’, কে সরকারের এজেন্সি, কে কাকে খুন করল, কে কাকে ভাড়া করে খুন করালো– এগুলো নিয়ে তো আমাদের কাছে তথ্য নাই। এবং কোনো খুন সম্পর্কেই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে, আইন-বিচার-পুলিশের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে গ্রহণযোগ্য তথ্যসহ, প্রমাণসহ, দলিল-নথিসহ কোনো রকমের পরিষ্কার ধারণা আমাদের দেওয়া হয় নি। এ ব্যাপারে সরকারের সংস্থাগুলোর কোনো রকমের আন্তরিক আগ্রহ আমরা দেখি নি। (০০:০৫:৫১ – ০০:০৭:১০)
 

মুখস্ত খুন, মুখস্ত পূর্বানুমান

ঘটনা ঘটার চোখের পলকেই তারা মুখস্ত পূর্বানুমান মাথায় রেখে কথাবার্তা বলা শুরু করেন। যেহেতু এখানে ঘাড়ে কোপ মারা হয়েছে, সুতরাং এটা মনে হয় ওমুক-ওমুক গোষ্ঠীর কাজ। এখন ঘাড়ে কোপ মেরে মানুষকে খুন করলে সেটা যদি ‘জঙ্গি’দের কাজ বলে ধরে নিতে হয়; তাহলে এই সুযোগে অনেক রকমের লোকজনই ঘাড়ে কোপ দিয়ে খুন করে পার পেয়ে যাবেন। সেটা ‘জঙ্গি’দের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। সেই ‘জঙ্গি’রা কারা, কোথায় বাস করেন, সেগুলো যে আমরা খুব ভালো জানি তাও না। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই অত্যন্ত নিপীড়ক, অত্যন্ত খুনে একটা রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করেছে। এর প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন ধরেন র‌্যাব, ক্রসফায়ারের গল্প দিয়ে নিয়মিত খুন করে যাচ্ছে। আর ইদানীং তো পুলিশের নামে, গোয়েন্দা সংস্থার নামে লোকদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বা পুলিশ– তাঁদের কোনো দায় নাই যে, তাঁদের নাম দিয়ে এগুলো কারা করল? তাঁরা শুধু বলছেন, এগুলো আমরা করিনি। আমাদের নাম দিয়ে যদি অন্য কেউ করে তবে সেটার দায়িত্ব তো আমাদের না! (০০:০৭:১১ – ০০:০৮:২৮)
 

ক্ষমতাবানেরাই খুন করেন: রাষ্ট্রের ছাতার নিচে

কিন্তু আসলে পাওয়ারফুলরাই খুন করে এবং সরকারি-বেসরকারি-আধাসরকারি-সরকার-বর্হিভূত সর্বপ্রকার পাওয়ারগ্রুপগুলোর ভেতরে কোনো না কোনো রকমের নেটওয়ার্কিং থাকে। পাওয়ারফুলেরা পরস্পরের সঙ্গে মোটের ওপর বোঝাপড়া না করে বড়ো বড়ো খুনখারাবির দিকে যান না। খুনখারাবির ক্ষমতা, ক্রাইম করার ক্ষমতা ক্ষমতাসীনদেরই বেশি। পাওয়ারফুলদেরই বেশি। এবং এই সর্বপ্রকার পাওয়ারফুলরা কোনো না কোনোভাবে আমাদের সার্বিক রাষ্ট্রকাঠামোর ছাতার নিচেই কাজ করেন। তাই এগুলোর জন্য রাষ্ট্র যদি অন্যকে দোষারোপ করা শুরু করে তাহলে তো হয় না! রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। আর রাষ্ট্র যদি মনে করে, না, এসমস্ত খুনখারাবি কারা করছেন না করছেন সেগুলো আমরা খুঁজে বের করতে পারব না; তাহলে পরে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। আমাদেরকে ‘সরকারি ছুটি’ ঘোষণা করতে হবে। সরকারের জন্য ছুটি ঘোষণা করতে হবে। (০০:০৮:২৯ – ০০:০৯:৩২)
 

গুরুত্বপূর্ণ খুন, গুরুত্বহীন খুন

এটা গেলো একটা দিক। আর খোদ খুন জিনিসটা তো অবৈধ না! সরকার যদি মনে করেন উপযুক্ত কারণ আছে, সরকার মানুষকে মেরে ফেলতে পারেন। সেটা ফাঁসি দিয়ে পারেন, সেটা ক্রসফায়ার দিয়ে পারেন, কে জানে সেটা গুম করেও পারেন কি না, অন্যভাবেও পারেন কি না– সেগুলো আমরা জানি না। আবার অন্যান্য যে শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলো আছেন তাঁরাও যদি তাদের দিক থেকে কোনো উপযুক্ত কারণ নিজেদেরকে বোঝাতে পারেন, তাহলে তাঁরাও বৃহত্তর স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, ওমুক মতাদর্শের স্বার্থে, তমুক মতবাদের স্বার্থে, ওমুক রাজনীতির স্বার্থে মানুষকে খুন করতে পারেন। মানে খোদ খুন নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের কাছের লোকেরা খুন হলে তখন আমরা কয়েকদিন একটু বিচলিত হই। এই আর কি। (০০:০৯:৩৩ – ০০:১০:২৪)

কিন্তু ফরিদপুরে বা মাওয়ায় বা বাগমারায় বা রংপুরে মানুষ যখন খুন হয়ে যান, ঝিনাইদহে যখন ইসলামী ছাত্রশিবিরের পরিচয়ওয়ালা একের পর এক ছাত্রের মৃতদেহ এখানে-ওখানে পাওয়া তখন সেগুলোও খুন। সেই খুনগুলোকে নিয়ে আমরা কথা বলি না। আমরা যদি খুনকে ভাগ করি, ‘গুরুত্বপূর্ণ’ খুন, ‘গুরুত্বহীন’ খুন – কিছু মানুষের খুন হওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আবার কিছু মানুষের খুন হয়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ না – আমরা যদি এগুলো করি, তাহলে পরে মূল প্রশ্নটা থেকে সরে যাব। (০০:১০:২৫ – ০০:১১:০৭)

 

সমাজে আদৌ খুন কেন হয়?

মূল প্রশ্নটা হচ্ছে যে, সমাজে খুনটা কেনো হয়? যেসব দেশে অনেক বেশি বিচারব্যবস্থা চালু আছে সেসব দেশেও তো খুনখারাবি কমে না। সুতরাং শুধু বিচার দিয়ে আর আইন-আদালত দিয়ে খুন বন্ধ করা যায় না। আপনি যদি ছোট ছোট বদ্ধ জলাশয়গুলো রেখে দেন তাহলে মশার উৎপত্তি হতেই থাকবে। মশার উৎপত্তি নিয়ে আপনি যদি গোড়ায় যেতে চান তাহলে এই ধরনের জলাশয়কে বন্ধ করতে হবে। তো সমাজে যাবতীয় অপরাধ, খুনখারাবি– এগুলোর পেছনে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্যগত নানান ধরনের ঘটনা আছে। সেই ঘটনাগুলোর সঙ্গে খুনের কি যোগাযোগ আছে বা নাই সেগুলো নিয়ে যদি আমরা আলাপ না করি, তাহলে আমরা খোদ খুন জিনিসটার গোড়ায় যেতে পারব না। আজকে এক্স খুন হবেন, কালকে ওয়াই খুন হবেন। (০০:১১:০৮ – ০০:১১:৫৯)
 

রাজশাহীতে খুন হওয়াটা মনে হয় ভিক্টিমদেরই অভ্যাস

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেশি করে খুন হচ্ছে কেনো– এরকম প্রশ্ন অনেকে করছেন। প্রশ্নটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকেই করছেন! ভিক্টিমদেরকেই প্রমাণ করতে হবে যে, কেনো এখানকার লোকেরা বেশি ভিক্টিম হয়! জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ একবার ইমরান খানের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে বলছিলেন যে, তোমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীদের তো এটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে, খুন হয়ে যাওয়া। তো, এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের মনে হচ্ছে যে, এটা ভিক্টিমদেরই অভ্যাস! (০০:১১:৫৯ – ০০:১২:২৯)
 

সর্বপ্রকার খুনের দায়িত্ব সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের

কেনো আমরা খুন হচ্ছি, আমাদের এলাকাতে কোনো বিশেষ মুশকিল আছে কি না– সেটা আমাদেরই মুশকিল। রাষ্ট্রের কোনো মুশকিল নাই, রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্ব নাই! রাষ্ট্রের যদি কোনো মুশকিল না থাকে, রাষ্ট্রের যদি কোনো দায়িত্ব না থাকে (এখানে মোট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে কত ধরনের অস্ত্রধারী, সরকারী বাহিনী যে আছে, তার তালিকা প্রণয়ন করা কঠিন; ১৮, ১৯, ২০, ২২টা এরকম বাহিনী হয়ত আছে) তাহলে এত বাহিনী, এত অস্ত্র, এত ট্রেইনিং, এত র‌্যাব, এত ডিবি, এত ‘চিতা’, এত ‘কোবরা’, এত কিছু থাকার পরেও খুন হতেই থাকবে; আর, সরকার বা এ ধরনের সংস্থাগুলো বলবেন যে, এখানে আমাদের তেমন কিছু করার নাই। বা করার থাকলেও তাঁরা কি করলেন, না করলেন, কি পেলেন, না পেলেন– সেগুলো আমরা কোনোদিনও জানতে পারব না! কিসের ভিত্তিতে তাঁরা কথা বলছেন, সেগুলো আমরা কখনো জানতে পারব না। তাহলে সেসমস্ত কথায় আমরা কেমন করে আস্থা রাখব? (০০:১২:৩০ – ০০:১৩:৩০)
 

মুখস্থ মৃত্যু, মুখস্থ অনুষ্ঠানমালা
বিকল্প থাকে ...। যাঁরা খুন হচ্ছেন তাঁদের কমিউনিটির, তাঁদের সমাজের মানুষেরা যদি নিজেরা তদন্ত করতে নামেন অকুতোভয় হয়ে, তাহলে পরে একটা আশা থাকে। আমাদের নাগরিক সমাজ যদি নিজেরা তদন্ত কমিটি গঠন করেন সাহসের সঙ্গে, সততার সঙ্গে এই খুনগুলোর অন্ততপক্ষে তালিকা প্রণয়ন করেন, তদন্ত করেন; তাহলেও হয়ত আমরা কিছু তথ্য পেতে পারি। কিন্তু এগুলো করাও অনেক বিপজ্জনক, এবং এগুলো যারা করতে যাবেন তাঁরাও বিভিন্ন ক্ষমতাওয়ালা মানুষের রোষানলে-কোপানলে পড়বেন। জনসাধারণের মধ্যে একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, সরকার, তার এজেন্সিগুলো এবং গায়েবি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘জঙ্গি’রা এগুলো করে যাবে। এবং সরকারের সেখানে বেশি কিছু করার থাকবে না। (০০:১৩:৩১ – ০০:১৪:২৮)

 

এই পরিস্থিতি থাকলে আজকে আমি, কালকে আপনি, পরশুদিন আরেক জন খুন হবে। এবং খুনের পরে কি কি ধরনের অনুষ্ঠান করতে হয়, সেই অনুষ্ঠানগুলো আমরা একটার পর একটা করে যাব। পুলিশ পুলিশের অনুষ্ঠান করবেন, ক্রাইম সিন বানাবেন; সাংবাদিকেরা আবার তাঁদের অনুষ্ঠান করবেন, ক্যামেরা নিয়ে হাজির হবেন, কোনো রকমে কাভার করে আরেকটা প্রোগামের জন্য দৌড়াবেন। এগুলো তাঁদের জন্য চাকরি। পুলিশের জন্যও এটা চাকরি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যখন খুন হয়, আমাদের সহকর্মীরা কিছু বক্তৃতা করেন, এটা সেটা বলেন। তারপরে চার-পাঁচটা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। আজকেও শিক্ষক সমিতির শ্রদ্ধাভাজন সভাপতি বলেই ফেললেন যে, ওমুক-ওমুক সময়ে এরকম সব প্রোগাম আছে, আপনারা সবাই অনুগ্রহ করে এই ‘অনুষ্ঠানগুলো’তে যোগ দেবেন! মানে আমরা এখন মৃত্যু উদযাপন করব! আমরা এখন আমাদের ভাই-বোনেরা খুন হয়ে যাওয়ার পরে কি করতে হয় আমরা সব জানি। আমাদের ভূমিকা আছে, আমরা প্রতিবাদ করব; পুলিশের ভূমিকা আছে, পুলিশ পুলিশের কাজ করবে; মিডিয়ার ভূমিকা আছে, মিডিয়া মিডিয়ার কাজ করবে। এরকম করে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। কি করতে হয় আমরা জানি! (০০:১৪:২৯ – ০০:১৫:৩৭)
 

যদি আমরা না জানতাম এ ধরনের একটা খুন হয়ে যাওয়ার পরে আমি কি ধরনের ভূমিকা পালন করব, তাহলে একটু আশা থাকত। তাহলে হয়ত আমরা একটু ভাবতাম যে, কি করা যায়? কিন্তু এখন আর কোনো ভাবার সুযোগ নাই। অতীতের খুনগুলোর মধ্য দিয়ে মিডিয়া আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন– পুলিশ এটা করবে, মিডিয়া এটা করবে, খুনের এলাকার লোকজন-আত্মীয়-স্বজন তাঁরা এ ধরনের কথা বলবেন। সরকার এবং সরকারের দিককার লোকেরা ‘জঙ্গি’ ‘জঙ্গি’ বলে খুঁজবেন। আর আমরা বলতে থাকব যে: জঙ্গি-টঙ্গি আমরা বুঝি না, আমাদেরকে খুব পরিষ্কার করে, এটা তদন্ত করে খুঁজে বের করে আমাদেরকে জানাতে হবে প্রত্যেকটা খুন কে করেছেন, কারা করেছেন, কেনো করেছেন? (০০:১৫:৩৮ – ০০:১৬:২১)
 

ভাবতে হবে নতুন করে: দণ্ডবিধি জেলখানা রাষ্ট্র নিয়ে

এই খুব সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ সহকারে যদি আমরা ভাষ্য না পাই, তাহলে আমরা সরকারি-বেসরকারি-রাজনৈতিক দলের, এবং অন্যান্য মানুষের, পেশাজীবীদের, ছাত্র-শিক্ষকদের, আমজনতার কোনো কথাই আমরা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করতে পারব না। ফলে মূল জিনিসটা আমাদের বাইরে চলে যাবে। দণ্ডবিধি কি, শাস্তি কি, খুন কি, জেলখানা দিয়ে খুন কমানো যায় কি না, খুন সম্পর্কে অপরাধ বিজ্ঞানীদের ধারণা কি, সেই সমস্ত জিনিসগুলো নিয়ে খুনের পেছনকার মনস্তত্ত্ব কি, খুনের পেছনকার বৈষম্য-আর্থ-রাজনৈতিক ঘটনাগুলো কি, খুনের পেছনে আরো অন্যান্য কোনো বিষয় আছে কি না– এগুলো সব নিয়ে আমরা যদি অনেক যত্ন করে, অনেক সময় ধরে কাজ না করি এবং খুন-অপরাধ যেসমস্ত শাস্তি বদ্ধ জলাশয়গুলো, মশার বেলায় যেটা বললাম, ওরকম জলাশয়গুলোকে আমরা যদি বন্ধ করে দিতে না পারি তাহলে পরে এগুলো চলবে। এগুলো নিয়ে বাকিটা যেটা চলবে সেটা আমাদের অনুষ্ঠানমালা। এই যে আমি আপনার সাথে আলাপ করছি সেটা এই অনুষ্ঠানমালারই অংশ। আমরা ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানমালা উদযাপন করছি। এটা ‘লাইভ’ সম্প্রচার না, নিজেরাই ‘লাইভ’ অনুষ্ঠান করছি। তাজা অনুষ্ঠান, সম্প্রচার পরে হবে। এই তো! (০০:১৬:২২ – ০০:১৭:০৭)
 

সাক্ষাৎকার-স্থল: সেলিম রেজা নিউটনের বিশ্ববিদ্যালয়স্থ কোয়ার্টারের পড়ার ঘর
সাক্ষাৎকার আয়োজন ও অনুলিপি প্রণয়ন: প্রদীপ দাস, এনটিভি অনলাইন, রাবি
শিরোনাম, উপশিরোনাম ও সময়াঙ্ক সংযোজন এবং অনুলিপি-পরিমার্জনা: সেলিম রেজা নিউটন

ভিডিওচিত্র ধারণ: সেলিম রেজা নিউটনের স্যামসাং জে সেভেন সিরিজের মোবাইল ফোন
সাক্ষাৎকারের এনটিভি-প্রচারিত লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=JLZ13dFW6js
সেলিম রেজা নিউটন কর্তৃক আপলোড করা ভিডিওর লিংক: https://www.minds.com/newsfeed/693757384673206291

উপরের গ্রাফিক ছবি: সেলিম রেজা নিউটন। এনটিভি-প্রচারিত সাক্ষাৎকারের ইউটিউব ভিডিওর স্ক্রিনশট অবলম্বনে। ব্যবহৃত সফটওয়ার ইঙ্কস্কেপ, জিএনইউলিনাক্স, ডেবিয়ান।

 
  PDF
 
 
 
 
Logo